মেঘদূত কালিদাস
এক যক্ষ অত্যধিক পত্নীপ্রেমবশতঃ নিজ কর্তব্যকর্মে অবহেলার অভিযোগে অভিশপ্ত হয়েছিল—এক বৎসরের জন্য সমস্ত ক্ষমতাশূন্য হয়ে তাকে পত্নী বিরহিত জীবন অতিবাহিত করতে হবে রামগিরির আশ্রমে। এই রামগিরিতেই একদা রাম- সীতা বসবাস করেছিলেন। জনকতনয়ার স্নানে এখানকার বারিধারা পূতপবিত্র ; সবুজ বৃক্ষছায়ায় সর্বদা সখস্পর্শ অনুভূত হয়। এই তীর্থেই শত্রু হল তার নির্বাসিত জীবন । ১
সেই মত কয়েকমাস অতিবাহিত হল। পত্নী বিরহে তার নধর দেহ দুর্বল হয়ে পড়ল, ফলে হাতের স্বর্ণনির্মিত বালাখানি শিথিল হয়ে গেল। অবশেষে আষাঢ় মাসের প্রথম দিনটিতে দেখল আকাশে শৈলনিতম্বের আলিঙ্গনে আবদ্ধ একখণ্ড মেঘ। মনে হল যেন মদমত্ত একটি হস্তী পর্বতের তলদেশ খননের খেলায় মত্ত হয়েছে। ২
সেখানে থেকে রাজ-রাজের অনচর বিরহী যক্ষ সেই হ্রদয়বিদারক জলদের দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে অশ্রুবাষ্পবেগ সংযত করে অনেকক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে রইল । মেঘ সন্দর্শনে যেক্ষেত্রে সুখী ব্যক্তির হৃদয়ও অস্থির হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে কণ্ঠা- লিঙ্গনে উৎসক প্রণয়িণী যাঁর কাছে নেই, তাঁর শোচনীয় অবস্থা তো কহতব্য নয়। ৩
শ্রাবণ এসে গেল। বিরহী যক্ষ বিরহিণী প্রিয়ার প্রাণ রক্ষার্থে মেঘের দ্বারা নিজের কাশলবার্তা প্রিয়ার কাছে পাঠাবে ঠিক করল, ; করচি ফলের অর্ঘ্য সাজিয়ে প্রীতিপূর্ণ বচনে তাকে সন্তুষ্ট করে তার শুভাশুভ বিষয়ে অনসন্ধান করল । ৪
কিন্তু, প্রশ্ন হল ধর্ম, জ্যোতি, সলিল ও সমীরণ মিশ্রণে উৎপন্ন মেঘ কিভাবে সংবাদ প্রেরণ করবে ? কোথায় তার সংবাদ প্রেরণযোগ্য ইন্দ্রিয় ? বিরহী যক্ষ মেঘের সাহায্যে সংবাদ প্রেরণ কতদূর সম্ভব সেটা একবার ভাবল। কিন্তু কামজ্বরে জজ্জরিত ব্যক্তিরা তো চেতন অচেতন ভেদ করার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। ৫
মেঘের বন্দনার জন্য যক্ষ বলল, জগৎ বিখ্যাত পাঙ্কর ও আবৰ্ত্তক বংশে যে তোমার জন্ম, হে জলদ, আমি অ জানি। আবার আমি যে ইন্দ্রের প্রধান সঙ্গী হিসেবে ইচ্ছামত রূপ ধারণে সমর্থ সেও আমার জানা। আর সে কারণেই তোমার কাছে আমার প্রার্থনা। ভাগ্যদোষে আমার প্রিয়া দূরে একাকিনী আর আমি এখানে। তোমার মত গণবানের কাছে প্রার্থনা বিফল হলেও বরং ভাল তথাপি অধমের কাছে প্রার্থনা সফল হলেও তা প্রার্থনীয় নয়। ৬
হে মেঘ, সন্তপ্ত ব্যক্তিদের আমিই আশ্রয়। ধনপতি কবেরের ক্রোধে প্রিয়ার বিরহে আমি সন্তপ্ত। তুমি আমার সংবাদ বহন করে আমার প্রিয়ার কাছে অলকায় যাও। যেখানে যক্ষেশ্বরগণ বসবাস করেন, জানবে সেটা তীর্থ স্থানস্বরূপ। সেখানে বাইরের উদ্যানে দেখবে, ললাটে চন্দ্রশোভিত মহেশ্বরের মূর্তি বিরাজমান। তার দাতিতেই নগরের অট্টালিকা শোভা পাচ্ছে। ৭
আকাশপথে তোমার বিচরণ দেখলে বিরহী প্রোষিতভতাকা বিরহিণীরা আশান্বিত হবে এই ভেবে যে তাঁদের প্রিয়-মিলনের কাল বুঝি নিকটপ্রায়। বিরহ- জনিত অবিন্যস্ত কেশগুচ্ছ বিন্যস্ত করে তারা তোমাকে দেখবে। আমার মত পরাধীন ব্যক্তি ছাড়া আর কে আছে যে তোমার উদয়ে তার বিরহব্যাকলো প্রিয়াকে দেখেও গ্রাহ্য করবে না। ৮
মদ, মন্দ বাতাস যেমন প্রবাহমান তেমনি আনন্দবিভোর চাতক পাখির দলও তোমার বাম পার্শ্বে কজনরত। নয়নমনোহর বক মিথুনের ঝাঁক সামান্য পরিচয়- হেত্ত্বও তোমাকে সেবা করবে, কারণ তুমিই তো আড়াল রচনা করে তাদের মিলনের সুযোগ করে দাও। ৯
তুমি বিলম্ব না করে যদি অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাও তবে আমার একমাত্র পত্নীকে—তোমার ভ্রাতৃত্জায়াকে— দেখতে পাবে। দেখবে, সে আমার সাথে মিলনের আশায় দিন গণে চলেছে। সে এখনো জীবিত আছে এই কারণে যে বৃন্তে যেমন ফল আটকে থাকে তেমনি আশার,প ফলও নারী হৃদয়কে ধরে রাখে। ১০
তোমার গর্জন শুনে ভকন্দলী ফল মাটি থেকে মাথা তুলে ঘোষণা করে, পৃথিবী এবার শস্যশালিনী হবে ; সেই গর্জন শুনে মানস সরোবরে যাবার জন্য উৎসকে হয়ে ওঠে রাজহংসের দল; মৃণালের টাকরোকে পাথেয় করে তারা কৈলাস পর্যন্ত তোমার সহযাত্রী হবে। ১১
এবার তোমার প্রিয়সখা রামগিরি পর্বতকে আলিঙ্গন করে বিদায় নাও। এই পর্বতের মেঘলা জগৎপজ্য রামচন্দ্রের পদাঙ্কে অঙ্কিত। কালে কালে তোমার সান্নিধ্য লাভ করেই তার বিরহী হৃদয় থেকে স্নেহবিন্দরূপে নিঃসৃত হয় জল- ধারা। ১২
হে মেঘ! তোমার যাত্রাপথের সন্ধান এবং আমার প্রিয়ার কাছে যে বার্তা নিয়ে যেতে হবে তা শোন। যাবার পথে পাহাড়ের শিখরগুলোতে একট, একট, বিশ্রাম নিও। যখনই অল্প অল্প জলবর্ষণের জন্য ক্লান্তি অনুভব করবে তখনই খানিকটা হালকা জল পান করতে যেন ভুলো না। ১৩
যখন তুমি আকাশপথে যাবে তখন সরলা সিদ্ধাঙ্গনারা বিস্মৃত হয়ে দেখবে আর ভাববে হয়ত বাতাস কোনো পাহাড়ের চূড়াকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে দেখবে নিচে সারি সারি বেতসকঞ্জ সাজান, সেখান থেকে উত্তর দিকে যাত্রা কোরো। দিকে দিকে দিঙনানরা তোমার পথরোধ করতে এলে তুমি তাদেরকে এড়িয়ে যেয়ো। ১৪
নানারকমের রত্ন যেমন একত্রিত হলে সন্দর দেখায়, দেখবে তেমনি সুন্দর ইন্দ্র- ধন, পর্বতের উপরে বল্মীকের স্তুপ থেকে উঠছে। সেটা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি দৃষ্টিনন্দন ইন্দ্ৰধন, তুমি উত্তর দিকে রওনা হলে তোমার দেহ সংলগ্ন হবে। কৃষ্ণ যেমন তাঁর মোহন চূড়ায় সন্দর ময়ুরপচ্ছে হেলিয়ে শোভা পান, তোমার শোভাও হবে ঠিক তেমনি। ১৫
কৃষিকর্মের ফল তোমার আয়ত্তাধীন, তাই পল্লীবধূদের প্রীতিপর্ণে কাটিল কটাক্ষহীন চাহনি সর্বদা তোমার দিকেই থাকবে। তাদের চাহনিতে মনে হবে যেন তারা তোমাকে চোখে চোখেই পান করে ফেলছে। আমি সদ্য হলকষিত ভূমির উপরে উঠলে সেই ভূমিখণ্ড সৌরভমণ্ডিত হয়ে উঠবে আর সেই সৌরভ আঘ্রাণ করতে করতে একটু পশ্চিম দিকে গিয়ে আবার উত্তর দিকে যাত্রা কোরো। ১৬
একটু উপরে উঠলেই দৃষ্টিগোচর হবে আম্রকট পর্বত। এর বনরাজি দাবানলে দগ্ধ হওয়ার সময় তোমারই সেই বারিধারায় দাবদাহ নির্বাপিত হয়ে ছিল। পথশ্রমে তোমাকে ক্লান্ত দেখে আম্রকট পর্বত কৃতজ্ঞতাবশতঃ তোমায় সাদরে মাথায় স্থান দেবে ৷ অতি নীচও উপকারী বন্ধকে আশ্রয়দানে বিমুখ হয় না, সুতরাং এই পর্বতও তোমায় আশ্রয় দিয়ে কৃতার্থই হবে। ১৭
পক্ক আম্রকাননে পূর্ণ এই পর্বতের শিখর দেশে তোমাকে মনে হবে তুমি যেন উপরে কালো কেশের বেণীর মত বিদ্যমান। তোমার অধিষ্ঠানে দেব দম্পতিরা আকাশ হতে দেখবেন পৃথিবী যেন পীন পয়োধর রূপে শোভিত ; তার চারদিক পাণ্ডুবর্ণ, শঙ্খ, বৃত্ত দেশটিই শ্যামবর্ণ । ১৮
বনচরবধ, পরিববৃত কঞ্জবনে কিছুকাল অবস্থান করে সেখানে বর্ষণ কোরো ৷ তারপর কিছুটা ভারমুক্ত হয়ে দ্রুতগতিতে ধাবমান হোয়ো। দেখবে, বিন্ধ পর্বতের পাদদেশে স্বল্পজলা রেবা নদী ধীরে ধীরে বহমানা। পর্বতের গায়ে নদীর নানান ধারা মনে হবে যেন হস্তীদেহে বিভিন্ন রেখায় রচিত সজ্জা। ১৯
ওহে মেঘ! তুমি তো সেখানে বর্ষণ করবেই ; কিন্তু, বর্ষণের পর গজমদধারায় বাসিত রেবা নদীর স্বাদ,, সুরভি ষায় বারি পান কোরো। ভেতরে কিছু সার থাকলে বাতাস আর তোমাকে তুলোর মত যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবে না। যার ভেতরটা শূন্যে সে লঘ, যে পরিপূর্ণ সে কখনো রিক্ত নয় । ২০
তুমি যে পথ দিয়ে যাবে সে পথে তোমার বর্ষণে সিক্ত ভূমিতে কদম্ব ফল ফটে সবুজ ও পাংশ,বর্ণের মিশ্রণে এক অপূর্ব শোভা ধারণ করবে। দেখবে সেই ফলের কেশর অর্ধেক ফাটে আছে। কোথাও আবার নজরে পড়বে নদীর তীরে তীরে ভাই চাঁপা ফাটে রয়েছে। নিদাঘতাপে ক্লান্ত বনভূমি বারিধারায় স্নাত হয়ে মধর গন্ধ বিতরণ করবে। সেই গন্ধ শংকতে শকতে হরিণ হরিণীর দল তোমার জলবিন্দ পাতে শীতল পথ ধরে ছুটে যাবে। তারাই জগৎকে বলে দেবে তুমি এই পথ ধরেই গিয়েছ। ২১
চতুর চাতক ভূমিতে জলবিন্দু, পড়ার আগেই তা পান করে। সেখানে দেখবে নিপুণভাবে জলপানে সক্ষম চাতকদের দেখতে দেখতে সিদ্ধেরা মানসযাত্রী সারিবদ্ধ বলাকার দলকে সংখ্যাগনণার বিধিমতে গণনা করে চলেছেন। সেই সময় যদি হঠাৎ মেঘগর্জ'ন হয় তাহলে সচকিত কম্পিত, ভীত সিদ্ধাঙ্গনারা সঙ্গে সঙ্গে তাদের পতিদের বক্ষলগ্না হবে এবং অপ্রার্থিত আলিঙ্গনে সিদ্ধেরা খুশী হয়ে নিশ্চয়ই তোমাকে অতি- শয় সমাদর করবেন। তাছাড়া ঐ দৃশ্যে দেখে তুমি আনন্দ পাবে। ২২
ওগো সখা, আমি জানি, আমার প্রিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তুমি তাড়াতাড়ি যাবে, কিন্তু তব, মনে হয় পথে প্রতি পর্বতেই তোমার দেরি হয়ে যাবে, কারণ করচি ফলের গন্ধ তোমাকে আমোদিত করবে। তাছাড়া সাদা সাদা জলভরা চোখে ময়ূরের দল তোমার দিকে তাকিয়ে তোমায় স্বাগত জানাবে। তখন তুমি কি তা উপেক্ষা করে দ্রুত যেতে পারবে ? ২৩
এরপর তোমার চলার পথে পড়বে দশদর্গ সমন্বিত দশার্ণ দেশ। তুমি সেখানে উপস্থিত হলে মৃণাল খণ্ড মখে নিয়ে রাজহংসের দলও সেখানে দিনকতক থেকে যাবে। জায়গাটার চারদিকে জামগাছে ঘেরা বন, পরিপক্ক ফল, কেতকী গাছের বেড়া, তার মধ্যে মধ্যে উদ্যান। তোমার উপস্থিতিতে দেখবে তাতে কাড়ি ফটে উঠবে, আর দেখবে গ্রামের মধ্যে রাস্তার ধারে ধারে গৃহবলিভক্, পাখিরা বাসা বাঁধতে ব্যস্ত রয়েছে। ২৪
দশার্ণদেশের রাজধানী বিদিশা। সেখানে গেলে তোমার বিলাসী হৃদয়ের বাসনা পূর্ণ হবে। সেখানে তরঙ্গিত বেত্রবতীর পেয় জল খানিকটা পান করে নিও। মনে হবে নদীর পিণী নায়িকা যেন ভ্রূ, কম্পিত করে তোমায় নিষেধ করছে জলপান করতে ; কলকল রবে তার কণ্ঠস্বর ব্যক্ত হবে। তীরোপান্তে তুমিও তখন মৃদ্, গর্জন করে উঠো। ২৫
‘নীচৈঃ নামে সেই নগরীর উপকণ্ঠে একটি সুন্দর পর্বত আছে। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম কোরো। তোমার পরশে কদম্বফল পালকিত হয়ে উঠবে। সেখানে নির্জন গিরিগুহায় সৌখিন নাগর ও বিলাসিনী নগরাঙ্গনারা মিলিত হয়, তাদের সুবাসিত অঙ্গের কসম গন্ধে গুহাগৃহগুলি সর্বদা পরিপূর্ণ থাকে । ২৬
পাহাড়ে বসে যতটা পার বিশ্রাম করে তারপর যাত্রা করবে। নিচে বননদীর দুই তীরে দেখবে ফলের বাগান, সেখানে রয়েছে রাইফালের ঝাড়। সেই বাগানে তোমার জলধারা সিঞ্চন কোরো। পুষ্পোদ্যানে যে রমণীরা পুষ্প চয়নে আসে, দেখবে তারা রৌদ্রতাপে ঘর্মাক্ত, ঘাম মুছতে গিয়ে কানেপরা পদ্মফলে আঘাত লাগছে । আমি তাদের ছায়া দান করলেই দেখতে পাবে তারা তোমাকে অভিনন্দিত করছে। ২৭
উত্তরদিকে যাত্রা হলেও সোজা উত্তরে যাওয়া চলবে না। পথ কিছুটা বাঁকা হলেও তোমাকে উজ্জয়িনী দেখে যেতেই হবে। সেই নগরীর আকাশচুম্বী সৌধশিখর প্রাঙ্গণে একট, বসে যেয়ো—প্রেমে বিমুখ হয়ো না। উজ্জয়িনীর আয়তাক্ষীদের নর্তনশীল ও দীপ্তিময় চোখ না দেখলে জীবনটাই বৃথা ৷ ২৮
পথে নিবিন্ধ্যা নদী পড়বে। দেখবে কলকল শব্দে নদী তরঙ্গিত ৷ হংসের শ্রেণী উজানদিকে সাঁতার কেটে আসছে, তাদের কলধ্বনি ও জলের কলধ্বনি মিলে সৃষ্টি- হচ্ছে মধর ঝঙ্কার। এ যেন নিবিন্ধ্যায় চন্দ্রহারের ঝমঝমধ্বনি। বাধাহীন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে নদীর আবর্ত। ঠিক যেন নদীসন্দরীর নাভি-পে। সেখানে নেমে রসাস্বাদ করে তবেই যাত্রা কোরো। অনেক কথা বলার ক্ষমতা ওর নেই ; তবে জানবে, ভাববিলাসই হচ্ছে নারীর প্রণয়ভাষণ। ২৯
ওহে মেঘ ! তোমার বিরহে একগাছি বেণীর মত হয়ে গেছে সিন্ধুনদী। তির তির করে বইছে জলধারা। উভয় তীরের তরুরাজি থেকে যত রাজ্যের জীর্ণ পাতা পড়ে সেই জলধারাকে একেবারে পাণ্ডুবর্ণ করে ফেলেছে। বিরহ দশায় তোমারই সৌভাগ্যের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে সে। যাতে এই নদী কশতা ত্যাগ করতে পারে তার ব্যবস্থা কোরো। তোমার বারিধারায় সে যেন প্লাবিত হয় । ৩০
এবার আসবে অবন্তী। এ দেশের গ্রাম্যবৃদ্ধেরা উদয়ন-কথায় সদক্ষ। সেখান থেকে যাবে 'বিশালা' নদীতে। এ নগরী সম্পদে ও সৌন্দর্যে সত্যিই বিশাল। সেখানে গেলে মনে হবে যারা পণ্যফলে স্বর্গে গমন করেছিলেন তাঁরা পণ্যফল শেষ হবার আগেই স্বর্গের সৌন্দর্যের অংশ নিয়ে ধরাধামে ফিরে এসেছেন । ৩১
প্রভাতে প্রস্ফুটিত পদ্মফলের গন্ধে আমোদিত হয় শিপ্রার তরঙ্গপ্রবাহ। বাতাসে ধ্বনিত হয় সারসদলের মদকল ধ্বনি। সেখানে রমণীরা রাত্রির মিলনজনিত পরিশ্রম দূর করতে শিপ্রার বাতাস উপভোগ করে। এ বাতাস প্রিয়তমের প্রার্থনা ও চাট- বারিতার মতই রমনীয় । ৩২
দেখবে উজ্জয়িনীর রমণীরা ধূপ জ্বেলে তাদের মাথার চুল শুকোচ্ছে ; সেই ধূপের গন্ধ বাতায়ণপথে বাইরে এসে তোমার শরীরকে পষ্ট করবে, সেখানে গৃহে গৃহে পালিত ময়রের দল বন্ধ প্রীতি প্রদর্শনের জন্য তোমাকে দেখে আনন্দে নেচে উঠবে, বিভিন্ন প্রাসাদে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে মেঝেতে সুন্দরী রমণীদের পায়ে আলতার দাগ। এসব দেখেই তোমার পথের ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে । ৩৩
উজ্জয়িনীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গন্ধবতী নদীর তীরে চণ্ডিকাপতি মহেশ্বরের একটি মন্দির আছে। পবিত্র সেই মন্দিরে একবার যেও। মহেশ্বরের শরীরের রঙ নীল, তোমারও তাই ; সাতরাং তার অনুচর প্রমথেরা তোমার দিকে সাগ্রহে না তাকিয়ে পারবে না। মন্দিরের পাশে একটি সুন্দর বাগান আছে ; সেই বাগানকে সর্বদা কম্পিত করে বয়ে চলেছে পদ্মগন্ধ আর জলকেলিরত যুবতিদের দেহগন্ধে সুবাসিত পদ্মবতী নদীর জল স্পর্শ কারী বাতাস। ৩৪
হে মেঘ! যদি অন্য কোনো সময় হঠাৎ সেই মন্দিরে গিয়ে উপস্থিত হও তবে একট, অপেক্ষা কোরো, যতক্ষণ না সূর্য তোমার দৃষ্টিপথ থেকে সরে যায়। সন্ধ্যার আরতি শব্দ হলে তুমি তোমার গম্ভীর কণ্ঠে একটু গর্জন কোরো ; তাহলে আর ঢাকের প্রয়োজন হবে না, এদিকে আমিও দেবসেবার পণ্যে পণ্যবান হবে। ৩৫
সেই মন্দিরে নৃত্যরত দেবদাসীরা মহাকালকে চামর ব্যঞ্জন করে ; তাদের পায়ের তালে তালে মেখলার ঝঙ্কার ওঠে। তাদের সেই চামর অদ্ভুত সব রত্নে পরিপূর্ণ। ব্যঞ্জন করতে করতে তাদের হাত ক্রমশ শিথিল হয়ে আসে। সে সময় প্রিয়জনের নখক্ষত্যক্ত অঙ্গে যদি দয়াবশতঃ আমি বিন্দু বিন্দ, বারিসিঞ্চন কর তাহলে দেখবে অসংখ্য ব্যাকল ভ্রমরের মত তাদের নিক্ষিপ্ত কটাক্ষ তোমার প্রতি তীরবেগে ছুটে আসছে। ৩৬
তারপর গিয়ে উপস্থিত হয়ো মহেশ্বরের দীর্ঘ বাহর সঙ্গে তুলনীয় বনস্পতিপূর্ণ বনে, সেখানে সন্ধ্যা হলে নববিকশিত জবার মত রক্তিমাভ হয়ে উঠবে। এভাবেই মহে- ঘরের নৃত্য শত্রুর মুহূর্তে তাঁর সিক্ত নাগচর্মে'র জন্য আগ্রহ নিবারণ কোরো। যদি তা করতে পার তাহলে দেখবে গিরিনন্দিনীর হৃদয় শান্ত হয়েছে, তিনি তোমার শিবভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তোমার প্রতি শান্ত দৃষ্টিতে চাইবেন। ৩৭
উজ্জয়িনীর রাজপথে গভীরতর অন্ধকারের মধ্যে লক্ষ্য করে দেখো অভিসারিকার দল দয়িতের উদ্দেশ্যে চলেছে। সে সময় তোমার বিদ্যাৎ যেন কষ্টিপাথরের স্বর্ণ- রেখার মত মৃদুভাবে ঝলসে ওঠে। সেই সামান্য আলোতেই তারা তাদের পথ দেখে ওরা সত্যিই ভীষণ ভীরু। ৩৮
বার বার ঝলসাতে ঝলসাতে তোমার বিদ্যা ৎপ্রিয়া ক্লান্ত হয়ে পড়বেই, সুতরাং সে রাত্রিটা কোনো প্রসাদের শীর্ষ দেশের চিলেকোঠায়, যেখানে পারাবতের দল ঘুমিয়ে থাকে, কাটিয়ে দিও। তবে সূর্য উঠার সাথে সাথেই কিন্তু আবার পথ চলা শর করে দিও। কারণ জানই তো, বন্ধর প্রয়োজন মিটিয়ে দেবার ভার নিয়ে পথে বিলম্ব করাটা শোভনীয় নয় ৷ ৩৯
সেই সময় কত প্রণয়ী এসে খণ্ডিতা নায়িকাদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে। সুতরাং আমি আবার যেন তখন সূর্যকে আড়াল করে থেকো না। তিনিও তো আসছেন নলিনীর অশ্রু, মুছিয়ে দেবার জন্যই ; অতএব তাঁর পথরোধ করলে তাঁর পক্ষে ক্রুদ্ধ হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। ৪০
আর একটু এগোলেই চোখে পড়বে গম্ভীরা নদী। হৃদয়ের মত স্বচ্ছ তার জল। সেই জলে তোমার ছায়া পড়বে। সেই ছায়ায় প’টিমাছগুলো এমনভাবে লাফাতে থাকবে যে মনে হবে গম্ভীরা যেন তোমার উদ্দেশে কটাক্ষবাণ নিক্ষেপ করছে। জানি, তোমার ধৈর্যের অন্ত নেই। কিন্তু তার সে কটাক্ষকে ব্যর্থ করে দিও না, দয়া করে অন্তত সামান্য বর্ষণও কোরো। ৪১
দেখো, গম্ভীরার স্রোতে কীভাবে গা এলিয়ে এপাশ ওপাশ করছে নীলবর্ণের বেতসলতার দল । উন্মুক্ত দুই তীরের দিকে তাকালে মনে হবে যেন গম্ভীরা তার নিতম্ব থেকে খসে পড়া কাপড় কোনোরকমে সামলাবার চেষ্টা করছে। তুমি যখন তার উপরে অবস্থান করবে তখন খুব সহজে সেখান থেকে সরে আসা সম্ভব হবে না ৷ পূর্বে আস্বাদিত কারো পক্ষে অনাবৃত জঘনা নারীকে উপেক্ষা করা কি সহজ? ৪২
তোমার বর্ষণে ধরণীর বুক থেকে উত্থিত হয়ে এক মধর গন্ধ চতুদিকে ছড়িয়ে পড়বে। জলধারার কলকল ধ্বনির সঙ্গে হাতির দল শ'র দিয়ে বায়, গ্রহণ করবে, আর তার প্রভাবে জুর বনের প্রতিটি জ্বর ধীরে ধীরে পেকে উঠবে । গম্ভীরাকে ছেড়ে যখন তুমি দেবগিরির উদ্দেশে যাত্রা করবে তখন এই বায়ুই তোমার পদসেবায় নিয়োজিত হবে। ৪৩
দেবগিরিতে দর্শন পাবে কার্তিকের। সেখানে পষ্পমেঘের রূপ ধরে, আকাশ গঙ্গার জলে সেই পষ্প ভিজিয়ে নিয়ে, তাঁর উপর বর্ষ‘ণ কোরো। সেখানে, দেবরাজ ইন্দ্রের সৈন্যদের রক্ষার উদ্দেশ্যে মহেশ্বর যে তেজ অগ্নিতে নিক্ষেপ করেছিলেন, সেই তেজই কার্তিকের রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে। ৪৪
কার্তিকের সেবা শেষ হলে তাঁর ময়ূরটিকেও একবার নাচিও। উমা তাকে আপন পত্রের মতই স্নেহ করেন। যদি কখনো তার চন্দ্রক আঁকা একটি পালক খসে পড়ে, অমনি উমা পদ্মের অলঙ্কার ফেলে দিয়ে সেই পালকটি উঠিয়ে কানে পরেন। মহেশ্বরও ময়ূরটিকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি যখন তার দিকে তাকান তখন ললাটচন্দ্রের দৃষ্টিতে তার চক্ষু দুটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তুমি সেখানে গর্জন করলে পর্বতের গুহায় সে গর্জন প্রতিধ্বনিত হয়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠবে। দেখবে, তাতেই ময়ূর নাচতে শুরু করবে। ৪৫
শরবনজাত কার্তিককে আরাধনা করে আবার যাত্রা শরু কোরো। আকাশপথে যেতে যেতে বীণা হাতে সিন্ধ মিথুনকে দেখতে পাবে। তারা তোমার জলকণার ভয়ে নিজে থেকেই পথ ছেড়ে দেবে। একটু অগ্রসর হলে চোখে পড়বে চর্মস্বতী নদী । এ নদী দেখলে মনে হবে যেন রাজা রস্তিদেবের কীর্তিই স্রোতধারায় পরিণত হয়েছে। তাকে সম্মান জানাবার জন্য সেখানে একটা অপেক্ষা কোরো। ৪৬
তোমার শ্যামবর্ণ দেখলে মনে হয় যেন কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ চুরি করেছ। তুমি জলসংগ্রহের জন্য যখন সেই নদীর দিকে ঝুকবে তখন আকাশবিহারী সিদ্ধপুরুষের দল নতদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ভাববেন যেন একছড়া মুক্তোর মালার মধ্যে একটি ইন্দ্রনীল মণি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও চর্মস্বতী বেশ প্রসা রিত, তব, দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একগাছি সর তো পড়ে রয়েছে। ৪৭
চর্মস্বতী পার হলে চোখে পড়বে দশপর নগর। সেই নগরের গৃহবধূর দল তাদের সুন্দর চোখের সর্ব পরিচিত ভ্রূ হলে তোমায় চেয়ে চেয়ে দেখবে । তখন মনে হবে যেন কেউ একরাশি কন্দেফুল আকাশের দিকে ছড়ে দিচ্ছে, আর তার পেছন পেছনে ছুটে চলেছে কৃষ্ণবর্ণ ভ্রমরের দল । ৪৮
এরপর ব্রহ্মবর্ত। এই দেশ অতিক্রমকালে তোমার স্নিগ্ধ ছায়ায়, সে কিছুক্ষণের জন্য শীতল হবে। তারপর পড়বে ক্ষত্রিয় যুদ্ধের চিহ্নভূমি কর ক্ষেত্র। তুমি যেমন প্রচণ্ড বর্ষণে অজস্র পদ্মকে ছিন্ন কর, তেমনি ধনুর্ধারী অজ্জনও এই যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষত্রিয়রাজাদের মুখে শতসহস্র তীক্ষ্ণ তাঁর বর্ষণ করেছিলেন। ৪৯
বন্ধুর প্রতি স্নেহবশত উদারহৃদয় হলধারী বলরাম রেবতীনয়ন প্রতিবিম্বিত সুরাপাত্রও অচ্ছ করে যে নদীর তীরে সমাধি অবলম্বন করেছিলেন সেই সরস্বতী নদী তোমার যাত্রাপথে পড়বে। সেই সরস্বতীর পবিত্র জল পান করলে, বর্ণে কালো থাকলেও অন্তর তোমার পতপবিত্র হয়ে যাবে। ৫০
সরস্বতী অতিক্রম করলেই পড়বে কনখল। তার খুব কাছেই হরিদ্বারে হিমালয়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে গঙ্গা। দেখলে মনে হবে যেন এই সিড়ি বেয়েই সগর রাজার পাত্রেরা স্বর্গে গিয়েছিলেন। পাহাড়ের গায়ে খাদে খাদে জমান ফেনার দিকে তাকালে মনে হবে সতীন উমার ভ্রকাটিকে অচ্ছ করে গঙ্গা হাসতে হাসতে তরঙ্গরূপে দ, বাহ, দিয়ে শিবের জটাকে আকর্ষণ করছেন । ৫১
তুমি যদি তোমার দেহের পেছন দিকটা আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে দিগ্গজের মত নির্মল স্ফটিকের শত্রুতাসম্পন্ন গঙ্গার পবিত্র জল পান কর, তখন তোমার কালো ছায়া তার জলে পড়ে এমন একটি রং ধারণ করবে যে মনে হবে যেন ত্রিবেণী ছাড়াও অন্যস্থানে গঙ্গাযনার মিলন ঘটেছে। ৫২
এরপর চোখে পড়বে গঙ্গার উৎস তুষার আচ্ছন্ন হিমালয়ের শিখর। সেই শিখর- দেশে কস্তুরী মৃগের দল এসে বসাতে সেখানকার প্রতিটি শিলা কস্তুরী গন্ধে সুরভিত হয়ে গেছে। পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে তুমি যখন সেখানে গিয়ে বসবে তখন মনে হবে হয়ত ত্রিলোচনের শ্বেত বৃষ কোথাও নরম মাটিতে শিং গাঁতিয়ে এসেছে, তাই তার শৃঙ্গে কিছুটা কাদা লেগে রয়েছে । ৫৩
প্রবলবেগে বাতাস বয়ে যাওয়ার ফলে দেবদার, গাছগুলোর একটার সাথে আর একটার ঘর্ষণ হবে, তা থেকে জ্বলে উঠবে আগুন। সেই আগুনের স্ফুলিঙ্গ উড়ে এসে পড়বে চমরী মৃগের পাচ্ছে, তাতে তার পাচ্ছে পড়তে থাকবে। তখন তুমি প্রবল বারিপাত শত্রু কোরো। তোমার বারিপাতে হিমালয়ের দক শান্ত হবে । বিপন্নকে রক্ষা করার জন্যই তো মহতের যত কিছু সঞ্চয়। ৫৪
দেখবে, শরভ মৃগের দল সেখানে বিচরণ করছে। তুমি তাদের যাত্রাপথ ছেড়ে দিও। তা সত্ত্বেও যদি তারা রেগে গিয়ে লাফ দিয়ে তোমাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে সেক্ষেত্রে নিজেদেরই হাত পা ভাঙবে। তখন আমি শিলাবৃষ্টি করে তাদেরকে ঢেকে দিও। অচিত কাজে কেউ মত্ত হলে তার ভাগ্যে লাঞ্ছনা তো অনিবার্য । ৫৫
হিমালয়ের কে দেখবে চন্দ্রশেখরের পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে। সিদ্ধপরুষেরা সর্বদা সেই পদচিহ্ন পূজো করেন। আমিও ভক্তিনম্র চিত্তে সেই চিহ্ন প্রদক্ষিণ কোরো। যাঁরা শ্রদ্ধাসহকারে এই চিহ্ন দর্শন করে তারা সব পাপ থেকে মুক্ত তো হয়ই, চিরদিনের জন্য প্রমথদের পদলাভেরও অধিকারী হয়। ৫৬
সেখানে বাঁশের ছিদ্রে বাতাস ঢাকে মধুর সঙ্গীত তোলে, আর তার রে রে কিন্নরীরা শিবের ত্রিপরবিজয় কাহিনী গেয়ে যায়। সেখানে যদি তুমি তোমার মদ্রধ্বনি উচ্চারণ কর এবং সেই ধ্বনি যদি গুহার গুহায় প্রতিধ্বনিত হয়ে মৃদঙ্গের রূপ নেয় তাহলে তাদের শিববন্দনা সার্থক এবং সম্পূর্ণ হবে । ৫৭
এই এলাকা অতিক্রম করলে পথে আর একটি পর্বতের দর্শন পাবে—তার নাম হংসদ্বার বা ক্রৌঞ্চরন্ধ্র। এই রন্ধ্র সৃষ্টি হয়েছিল পরশুরামের নিক্ষিপ্ত বাণে। এ পথ ধরে সোজা যাওয়া সম্ভব নয়, একটু বে'কে দেহটাকে লম্বা করে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে হবে। তখন তোমাকে দেখতে হবে ঠিক বামনরূপে বলিকে ছলনা করার সময় বিষ্ণুর শ্যামবর্ণ উদ্যত চরণের মত । ৫৮
এভাবে উপরের দিকে যেতে যেতে একসময় কৈলাসের আতিথ্য লাভ করবে। সেখানের পর্বতশৃঙ্গগুলি এত শত্রু যে মনে হয় যেন আয়না। সেই আয়নাতেই সরসন্দেরীরা তাদের প্রসাধন সারে। রাবণ একবার ঝাঁকি দেওয়ায় এই পর্বতের নিম্নদেশ অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে। উপরের দিকে রয়েছে অজস্র শৃঙ্গ—প্রতিটিই শ্বেতপদ্মের মত শুভ্র তুষারে আচ্ছাদিত। দেখলে মনে হবে যেন মহেশ্বর অট্টহাসি করছেন। ৫৯
কাজলের দুটি ভাঙ্গলে তার মধ্যে যে ঘন কৃষ্ণবর্ণ দেখা যায়, তোমার রঙ ঠিক তেমনি ; আর দাঁতকে যদি ভেঙ্গে ফেলা যায় তাহলে যে রঙ দাঁড়ায় কৈলাসের রঙ তাই। তুমি যখন তার সানুদেশে লেগে থাকবে, মনে হবে যেন বলরামের কাঁধে একটি শ্যামারঙের উত্তরীয় দেওয়া হয়েছে। এই অপূর্ব সৌন্দর্য সবাই অবাক হয়ে দেখবে। ৬০
অলকার প্রতিটি প্রাসাদই গুণে তোমারই সমকক্ষ। তোমার মধ্যে যেমন বিদ্যুৎ আছে, তেমনি সেখানে রয়েছে বিদ্যাতের মত দীপ্তিময়ী রমণীরা। তোমার মধ্যে যেমন বিচিত্র ইন্দ্রধনর অবস্থিতি, তেমনি সেখানকার প্রাসাদগুলিতেও দেখতে পাবে নানা- রঙের চিত্র। তোমার মতই স্নিগ্ধ ও গম্ভীর ধ্বনির অনরূপে সঙ্গীতের সঙ্গে মৃদঙ্গের ধ্বনি সেখানে ক্রমাগত বেজে চলেছে। তুমি যেমন জলময়, প্রাসাদের মণিজালে বিরচিত মসৃণ ভূমিকেও তেমনি জলময় বলেই মনে হয়। উচ্চতায় সেই প্রাসাদগুলি তোমার মতই আকাশচুম্বী। ১
অলকার বধদের হাতে হাতে দেখবে লীলাকমল, অলকদামে ঝুলছে কন্দ- পুষ্প, আর লোধ্নফলের পরাগে তাদের মুখমণ্ডল পাও বর্ণ ধারণ করেছে। নজরে পড়বে খোঁপার পাশে সদ্য প্রস্ফুটিত করবক ফল, দ-কানে দুলছে দুটি শিরিষপাম্প আর সিথিতে রয়েছে প্রথম বর্ষার বিকশিত কদম্ব। ২
অলকার কোনো বৃক্ষই কখনো পুষ্পহীন হয় না। মধুলোভী ভ্রমরের দল সর্বদা সেখানে গণগণে করছে। পদ্মহীন সরোবর সেখানে দেখতেই পাবে না । সব সময় হাঁসের দল তাকে এমনভাবে ঘিরে থাকে যে মনে হয় যেন মেঘলা পড়েছে ৷ গৃহপালিত ময়,রগুলো সেখানে সর্বদাই দীপ্তিময় ; তাদের কেকাধ্বনিতে চাদিক মুখর হয়ে থাকে । সর্বদা আলোকিত জ্যোৎস্নায় পারো এলাক৷ ছেয়ে থাকায় অন্ধ- কার কি তা বোঝাই যায় না । ৩
সেখানে যারই চোখে অশ্রু, দেখবে, বুঝবে তা আনন্দ থেকে উদ্ভূত, অন্য কোনো কারণে নয়। সেখানে যত দুঃখ সব মদনের পুষ্পের আঘাতের জন্য, অন্য কোনো দুঃখের খোঁজই পাবে না। প্রিয়জন কাছে এলেই তার অবসান ঘটে । সেখানে যৌবন ছাড়া যক্ষদের কোনো বয়স নেই, প্রণয়জনিত কলহ ছাড়া কোনো বিচ্ছেদ নেই। ৪
সেখানে প্রাসাদের শাস্ত্রমণি নির্মিত ভূমিতে ছড়ান বিচিত্র ফলের সমাহার দেখে মনে হয় যেন আকাশের তারার ছায়া মাটিতে লটোপটি খাচ্ছে। কামিনীদের নিয়ে সেখানে যক্ষেরা উত্তম সরা পান করছে। আর তখন তোমার গভীর মন্ত্রের মতই মদেঙ্গের ধ্বনিতে সেই ভোগভ মি মুখরিত হয়ে উঠছে। ৫
দেখবে, মন্দাকিনী নদীর তীরে যক্ষ কন্যারা খেলা করছে। খেলাটা হচ্ছে, স্বর্ণ- রেণর মত মষ্টিবদ্ধ বালকো নিক্ষেপ করে তাতে মণি লাকিয়ে ফেলে ছুটে গিয়ে সেটাকে খাঁজে বের করা। এই যক্ষ কন্যা রূপের কারণে দেবতাদের কাছেও প্রার্থনীয়। খেলা চলাকালীন মন্দাকিনীর ছোঁয়ায় ভেজা বাতাস এসে তাদের সেবা করে, নদী তীরস্থ মন্দার তরে ছায়ায় রৌদ্রতাপ নিবারিত হয়। ৬
সেখানে কামিনী সন্দরীর দল যখন আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে তখন অনুরাগ- বশত তাদের কটিদেশের শিথিল হয়ে আসা বন্ধনগ্রন্থি প্রিয়তমেরা আকর্ষণ করে থাকে। তখন লজ্জাবনতা সুন্দরীরা একমষ্টি স্বর্ণ বালকণা নিয়ে উজ্জ্বল প্রদীপ শিখা লক্ষ্য করে ছড়ে দেয়। কিন্তু তাতে কোনো কাজই হয় না। কারণ রত্ন- প্রদীপ তো নেভান সম্ভব নয় । ৭
সেখানে আকাশচম্বী প্রাসাদগুলির উপরের তলার ঘরগুলোতে বহু সন্দর সুন্দর চিত্র সাজান রয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ বাতাসের বেগে মেঘের দল সেই সব ঘরে ঢুকে চিত্রগুলিকে ভিজিয়ে দেয়। তার পরমুহূর্তেই ভয় পেয়ে জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। মনে হয় যেন ধোঁয়ার রাশি বেরিয়ে যাচ্ছে। ৮
সেখানে রতিমন্দিরে মণির ঝালরে শয্যা সজ্জিত, পাশে ঝলছে চন্দ্রকান্ত মণির মশকদানি। রাতে মেঘের অবরোধমক্ত চন্দ্রকিরণ এসে যখন সেই চন্দ্রকান্ত মণির গায়ে পড়ে তখন তা থেকে বিন্দ, বিন্দ শীতল জলকণা বীৰ্ষত হয়। প্রিয়তমের গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধা রতিশ্রান্তা কামিনী সেই ধারায় আপন অঙ্গ শীতল করে। ৯
সেখানে সবার গৃহেই ধনের প্রাচার্য। ফলে সকলেই প্রতিদিন কবের ভবনের বাইরে বৈভ্রাজ নামে একটি উপবনে অপ্সরা আর কিন্নরদের নিয়ে বিচিত্র বিচিত্র সব গল্প বলে সময় কাটায়। কিন্নরেরা মাঝে মাঝেই অলকাপতি কবেরের যশোগাথা গাইতে থাকে। ১০
রাতের অন্ধকারে অভিসারিকার দল যখন দ্রুত পায়ে যায় তখন তাদের অলক থেকে মন্দার কমে খসে পড়ে, চন্দনাঙ্কিত কারুকার্যময় দেহের প্রসাধন ঝড়ে পড়ে, কোথাও বা কানের দুল মাটিতে পড়ে ল,টোপাটি খায়, আবার কারো হয়ত স্তনভারে হার কণ্ঠচ্যূত হয়। ফলে সূর্যোদয়ে সকলেই বুঝতে পারে অভিসারিকারা গত রাতে কোন পথ ধরে গিয়েছিল। ১১
সেখানে কাবের ভবনের বাইরে বসে আছেন কবের-সখা চন্দ্রশেখর ৷ ভয়ে মদন তাঁর ভ্রমরপংক্তির গণসম্বলিত পুষ্পধনটি নিয়ে সেখানে যান না। আশপাশে চরা সুন্দরীর দল তাদের প্রেমিকার প্রতি যে কটাক্ষ নিক্ষেপ করেন তাতেই তিনি আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেন । ১২
সেখানে রমণীদের সাজগোজের যত কিছু উপকরণ, যেমন বিচিত্র বসন, অলঙ্কার, কটাক্ষনিপূণ অঞ্জন, নববিকশিত পল্লবপঃষ্প, চরণরঞ্জিতকারী আলতা—সব একমাত্র কল্পবৃক্ষই জুগিয়ে থাকে । ১৩
সেখানে ক,বেরের গৃহের উত্তরে অবস্থিত আমার গৃহ দূর থেকেই দৃষ্টিগোচর হয় । তার প্রবেশপথ ইন্দ্রধনর শোভায় শোভিত। কাছেই রয়েছে একটি মাদ্দারতর। আমার প্রিয়তমা পালিত পত্রের মতই স্নেহ দিয়ে তাঁকে বড় করে তুলেছে। সেটি এত নিচ, যে হাত বাড়িয়েই তার পল্লব স্পর্শ করা যায়। ১৪
সেখানে মরকত শিলায় নির্মিত সোপানসহ একটি দীঘিও রয়েছে। সেই দীঘিতে বৈদ্য মণিময় মৃণালে সর্বদা ফটে রয়েছে স্বর্ণকমল। এর জলে সাঁতরে চলেছে হংসের দল। বর্ষায় তোমার দর্শনে তাদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাওয়ায় তারা আর নিকটবর্তী মানস সরোবরে যায় না। ১৫
সেই দীঘির পার ঘেসে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোমল ইন্দ্রনীল মণিতে সৃষ্ট শিখরদেশ সহ ক্রীড়া পর্বত। তার চতুদিক স্বর্ণকদলীতরতে বেষ্টিত। ফলে দর্শনীয় এই পর্বতটিকে আমার প্রিয়তমা খুবই পছন্দ করে। তোমার নীলদেহের চাদকে যখন বিদ্যাৎ ঝলক ওঠে তখন কাতরহ দয়ে আমি সেই পর্বতটির কথাই চিন্তা করি। ১৬
সেই ক্রীড়াপর্বতে করবক গাছ বেষ্টিত একটি মাধবীকঞ্জ রয়েছে। সেই কঞ্জের পাশে রয়েছে দুটি তরু। তার একটি হচ্ছে রক্তাশোক, অপরটি বকল। বাতাসের বেগে রক্তাশোকের পল্লব সর্বদাই কাঁপছে। সে আমার মতই প্রিয়ার বামচরণের আঘাত প্রার্থনা করছে, আর বক ল চাইছে তার মুখমদিরা। ১৭
তর, যুগলের একটির দাঁড় স্বর্ণনির্মিত। তাঁর মূলটি সবুজ বাঁশের রঙের মণিতে বাঁধান—তার উপরে স্ফটিক। দিনের আলো নিভে এলে তোমার বন্ধ নীল- কণ্ঠ ময়ূর এসে সেই দাঁড়ে বসে। তখন আমার প্রিয়া হাততালি দেয়, আর সেই তালে তালে সে নাচে। প্রিয়ার হাতের অলঙ্কারের রুনঝুন, ধ্বনিতে নৃত্যের তাল আরো মধুর হয়ে ওঠে। ১৮
এই সব লক্ষণ আর প্রবেশ পথে আঁকা একটি পদ্ম এবং একটি শঙ্খের কথা মনে রেখে তুমি আমার গৃহ চিনে নিতে পারবে। সূর্য ডুবে গেলে পদ্ম যেমন তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলে আমার অভাবে আমার গৃহও নিশ্চয় আজ তেমনি সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়েছে। ১৯
আকাশ থেকে নামার সময় হস্তিশাবকের মত রূপ নিয়ে তোমাকে প্রথম গিয়ে বসতে হবে সেই ক্রীড়াপর্বতের সুন্দর পাদদেশে। সেখান থেকে তোমার মৃদ বিদ্য তালোক নিক্ষেপ কোরো আমার গৃহাভ্যন্তরে। এরপর জোনাকির মত মিটমিটে বিদ্যাতের চোখ মেলে দেখা শর কোরো ভেতরটা। ২০
যাকে দেখতে পাবে সে তন্বী, শ্যামবর্ণা, পাকা ডালিমের বীজের মত শিখরযুক তার দাঁত, পাকা বিম্বফলের মত অধর, কটিদেশ ক্ষীণ, নাভি গভীর, নিতমভারে শ্লথ- গতি, স্তনভারে ইষৎ আনতা। তোমার মনে হবে যুবতী সৃষ্টির পক্ষে সেই হচ্ছে বিধাতার প্রথম আদর্শ । ২১
জানবে, সে-ই আমার দ্বিতীয় জীবন। আমিই তার একমাত্র সহচর ; অথচ আজ কত দূরে পড়ে রয়েছি। চক্রবাককে হারিয়ে চক্রবাকীর মত সে একা, নির্বাক হয়ে গেছে। নবীন যৌবনের দিনগুলো তার অতিবাহিত হচ্ছে অসহ্য বিরহ আর গভীর উৎকণ্ঠায়। তাই আশঙ্কা হয়, হয়ত তুষারপীড়িত কমলের মতই তার সৌন্দর্য একে- বারে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ২২
অবিরাম অশ্রুবর্ষণে তার চোখ দুটো ফালে দীপ্তিহীন হয়ে গেছে । ঘন ঘন নিশ্বাসের তাপে মলিন অধর, আর এলোমেলো চলে ঢাকা করতলে রাখা তার মুখে- মণ্ডল দেখলে, তোমার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলে চাঁদের যে অবস্থা হয়, মনে হবে তারও সেই অবস্থাই হয়েছে। ২৩
হয়ত দেখবে আমার কল্যাণ কামনায় সে পূজো করছে, কিংবা বিরহক্লিষ্ট আমার রূপে কল্পনা করে ছবি একে চলেছে, অথবা পিঞ্জরে আবদ্ধ সাধের সারিকাটিকে প্রশ্ন করছে, ‘তুমিও তো তাঁর কত প্রিয় ছিলে. আজ তাঁর কথা মনে পড়ছে কি ? ২৪
কিংবা হয়ত এও দেখতে পার, আমার প্রিয়া মলিন বসনে কোলের উপর বীণা রেখে স্বরচিত পদে আমার নাম এবং কালের পরিচয়সহ গান গাইছে। গাইতে গিয়ে চোখের জলে বীণার তার ভিজে উঠছে, বারবার চোখ মুছে আবার নতুন করে চেষ্টা করছে, কিন্তু, স্বরচিত স্বরও আর মনে পড়ছে না । ২৫
কিংবা হয়ত দেখবে প্রবেশ পথের মাখে একটি বেদী তৈরি করে বিরহ শরর দিন থেকে প্রতিদিন তাতে একটি করে ফল রাখতে রাখতে যত ফল জমেছে সেগুলো সে গনছে বিরহের দিন শেষ হতে আর কতদিন বাকি-জানার জন্য । হয়ত বা দেখবে সে ধ্যানমগ্ন হয়ে কল্পনায় আমার সঙ্গ উপভোগ করছে। প্রিয়তমের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে এই সব উপায় অবলম্বন করেই বিরহিণী তার চিত্ত বিনোদন করে থাকে। ২৬
দিনের বেলা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকায় তোমার সখী বিরহব্যথা ততটা অনুভব করে না। কিন্তু রাতে যেহেতু, মনকে ব্যস্ত রাখার অন্য কোনো উপায় নেই সেহেত তখন তাকে অনেক বেশি মনোব্যথা সহ্য করতে হয়। আমার খবর দিয়ে তাকে সুখী করার জন্য সেখানে গেলে দেখবে সেই সাধ্বী মাটিতে নিদ্রাহীন হয়ে পড়ে আছে। ২৭
পূর্ব দিগন্তে যেমন ক্ষীণ চন্দ্রলেখা দেখা যায় তেমনি ক্ষীণ দেহ নিয়ে মানসিক ক্লেশে বিরহশয্যার একপাশে সে শায়ে আছে। মিলনকালে সে আমার সঙ্গে যে মুখের রাত কাটাত তা মহর্তের মধ্যে কেটে যেত। অথচ বিচ্ছেদের দিনে সেই রাতই উষ্ণ অশ্রুজলে পূর্ণ হয়ে কী দীর্ঘায়ই না লাভ করেছে। ২৮
বাতায়ন-পথে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া জ্যোৎস্নার দিকে পূর্বপ্রীতিবশত তাকিয়ে সে আবার তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। গভীর দঃখে জলভরা অর্ধনিমিলিত চোখদুটি বন্ধ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন তার অবস্থা অনেকটা মেঘাচ্ছন্ন দিনের না খোলা, না বোজা স্থলপদ্মের মত। ২৯
তোমার নজরে পড়বে তার ঠোঁট দুটি উষ্ণ নিশ্বাসে মলিন হয়ে গেছে, সিথির দুপাশের চুল তেল না পেতে পেতে রক্ষে হয়ে উঠেছে, গড়িয়ে এসে পড়েছে ঘাড় অবধি। স্বপ্নেও যাতে আমার সঙ্গে মিলিত হতে পারে এই আশায় সে সর্বদা নিদ্রা কামনা করে, কিন্তু দং-চোখে জলের ধারা কখনো বন্ধ হয় না বলে নিদ্রা আসার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। ৩০
আমাদের ছাড়াছাড়ির দিনে মালাবিহীন যে কেশ সে বেধেছিল, যেদিন শাপ- মক্ত হব, সেদিন আমিই গিয়ে সেই কেশপাশ খুলব। ততদিন তাকে কেশপাশে ক্লিষ্টই থাকতে হবে। এখন সে বার বারই গণ্ডদেশে এসে পড়া বেণী বড় বড় আ-কাটা নখযুক্ত হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। ৩১
তার অঙ্গে আভরণ বলতে এখন আর কিছু নেই। গভীর দঃখে বারবার কোমল শরীরটাকে নিয়ে সে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। তাকে দেখে আমিও অশ্রুবর্ষণ না করে থাকতে পারবে না। কেননা যাদেরই হৃদয় কর ণায় সিক্ত তারা অন্যের দুঃখে অভিভ‚ত হবেই। ৩২
তোমার সখীর মন যে আমাতে ভীষণ অনুরক্ত তা আমি জানি। আর সে কারণেই সে আমাদের প্রথম বিচ্ছেদে এমন কাহিল হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত পত্নীপ্রেমে আমি প্রগলভতা দেখাচ্ছি না, যা সত্যি তা তুমি অচিরেই দেখতে পাবে। ৩৩
দেখবে, তার কাজলহীন নয়নের কোণে চার্ণকন্তল এসে পড়েছে। মদিরা ত্যাগ করায় সে নয়নে অভঙ্গী বলতে কিছু পাবে না। তুমি কাছে যাওয়া মাত্র দেখবে তার চোখের উপরের অংশ কাঁপছে। তা দেখে মনে হবে যেন জলের নিচে মৎসের ছটফটানীতে ফোটাপদ্মের পাপড়ি কম্পিত হচ্ছে। ৩৪
তোমাকে দেখামাত্র ফলবতী কলাগাছের মত তাঁর বাম উরু, কেপে উঠবে। সে উরুতে তো আর এখন আমার নখক্ষতের চিহ্ন পড়ে না। সম্ভোগঅন্তে আমি যে ক্লান্ত উর,তে সংবাহন করতাম সেই উরুতে সে আর এখন আগের মত মুক্তোর ঝালর পরে না ৷ ৩৫
ওগো মেঘ, যদি সেখানে পৌঁছে দেখ আমার প্রিয়া নিদ্রাস,খে অভিভূত, তাহলে গর্জন না করে পেছনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কোরো। কারণ সে হয়ত তখন স্বপ্নে আমাকে দর্শন কিংবা গাঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রয়েছে। সেই মুহূর্তে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমার কণ্ঠলগ্ন তার বাহ,লতা শিথিল হয়ে যাবে। দোহাই, তা হতে দিও না। ৩৬
তোমার স্পর্শে শীতল বাতাসের ছোঁয়ায় যেমন ভোরের মালতীর কাড়ি ফটে ওঠে তেমনি সেই বাতাসের স্পর্শে আমার প্রিয়ারও ঘুম ভেঙ্গে যাবে। আমি তোমার বিদ্যাৎ লাকিয়ে বাতায়নে গিয়ে বোসো ; দেখবে সে তোমার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে রয়েছে । তখন ধীরে ধীরে গড়গড় ধ্বনি তুলে তোমার বক্তব্য বলা শব্ কোরো। ৩৭
বলবে, হে সাধ্বি, আমি তোমার পতির অভিন্নহ দয় মিত্ৰ অৰুবাহ। তোমার জন্য তার কাছ থেকে কতকগুলি সংবাদ হৃদয়ে বহন করে এনেছি । বিরহিণী প্রিয়ার বেণীবন্ধনের জন্য অধীর প্রবাসী পতি যখন গৃহাভিমুখে যাত্রা করে তখন আমিই তার যাত্রাকে দ্রুততর করার জন্য পথে পথে গম্ভীর মধুর ধ্বনি করে চলি। ৩৮
এ কথা শোনামাত্র, পবনপুত্র হনুমান রামের সংবাদ বহন করে অশোকবনে সীতার কাছে পৌঁছলে তিনি যেমন তাঁর প্রতি সাগ্রহে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন, আমার প্রিয়াও তেমনি তোমার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, তোমাকে অভ্যর্থনা জানাবে, তোমার কথা মন দিয়ে শুনবে। বন্ধর মুখে প্রিয়তমের সংবাদ শোনা আর প্রিয়তমের সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই । ৩৯
হে বন্ধ, আমার অন রোধে আর তোমার নিজের কল্যাণের জন্য আমি তাকে বোলো, রামগিরি আশ্রমে তোমার প্রিয়তম সংস্থই আছে। তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন সে তোমার কাশল জানার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। মানষের বিপদ যখন তখন ঘটতে পারে, সতরাং আগে কশেল প্রশ্ন করাটাই সঙ্গত। ৪০
বলবে, বিরহ তাপে তোমার মতই তারও দেহ তপ্ত, তারও দেহ ক্ষীণ। তুমি যেমন তার জন্য উৎকণ্ঠিতা, সেও তেমনি সর্বদা তোমার জন্য উৎকণ্ঠিত। তুমি যেমন দীর্ঘ নিশ্বাসের উষ্ণ তাপে দগ্ধ হচ্ছ, সেও তেমনি আপন উষ্ণশ্বাসে দগ্ধ হচ্ছে। আজ তোমার সহচর প্রতিকূল দৈবের বশে দূরবর্তী বলে সঙ্কল্পের মাধ্যমে নিজেকে মনে মনে তোমার সঙ্গে মেলাতে চাইছে। ৪১
সখীদের সামনে প্রকাশ্যেই যে কথা বলা যায় সে কথাই সে তোমার স্পর্শ- লোভে কতবার কানে কানে বলেছে। অথচ আজ সে এতদূরে যে সেখানে না কথা, না দৃষ্টি—কোনোটাই পৌঁছবার উপায় নেই। সে কারণে তার উৎকণ্ঠিত হৃদয়ের কথা আমার মুখে মারফত তোমার কানে পৌঁছে দিতে সে আগ্রহী। ৪২
প্রিয়ঙ্গলতায় তোমার শরীর, চকিত হরিণীর চোখে তোমার দৃষ্টি, চন্দ্রবদনে তোমার মুখে, ময়রের কলাপগুচ্ছে কেশরাশি আর ক্ষীণতন, নদীর মৃদ তরঙ্গে ভ্রভঙ্গী—সবই সে বারবার দেখে ; কিন্তু, কোনোটাতেই তোমার পরো সাদৃশ্য চোখে পড়ে না। ৪৩
পাথরের বুকে লাল গিরিমাটি দিয়ে প্রণয় কলহে কাপিতা তোমার মতি এ'কে তার সঙ্গে তোমার চরণে পতিত আমার মুর্তিটিও যখন আঁকতে চেষ্টা করে, তখন আর পারে না ; জমে থাকা চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। পাছে চিত্রে তোমাদের মিলন হয়ে যায় এই ভয়ে নিষ্ঠুর বিধাতা এ কাজটক ও শেষ হতে দেন না। ৪৪
স্বপ্নে তোমাকে দেখার সাথে সাথে গাঢ় আলিঙ্গন আশায় দু-হাত শূন্যে তুলে সে তোমায় ধরার চেষ্টা করে। তা দেখে ব্যথিত বনদেবতার দল মুক্তাবিন্দর মত স্থূল অশ্রু বিন্দুতে তর পল্লব ভিজিয়ে দেয়। ৪৫
উত্তরের তুষার পর্বত থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত সমীরণ, নবীন দেবদারুর কসম- নির্গত ক্ষীরের গন্ধে সুরভিত বায়ুকে সে এই আশায় আলিঙ্গন করে যে সে হয়ত তোমার সর্ব অঙ্গের স্পর্শ নিয়ে বয়ে চলেছে। ৪৬
ত্রিযামা রাত্রি কিভাবে মূহর্তের মত সংক্ষিপ্ত হয়ে আসবে সর্ব অবস্থাতেই দিনের তাপ কিভাবে কমবে তা নিয়ে প্রতিমহতেই সে ভেবে চলেছে। কিন্তু কোনো পথ পায় না। তোমার বিরহবেদনার উত্তাপে সে সর্বদা জ্বলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তার নিরাশ্রয় হৃদয়কে কে আশ্রয় দেবে। ৪৭
অনেক ভেবে শেষে সে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিয়েছে। তোমাকেও বলেছে, তুমি একেবারে ভেঙ্গে পোড়ো না। মানুষের ভাগ্য কেবলমাত্র চক্রের প্রান্তভাগের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। সেখানে কেউ চিরস্থায়ী সংখ কিংবা চিরস্থায়ী দঃখ পেতে পারে না ; ভাগ্যচক্রের আবর্তনে সর্বদা তার ওঠা নামা চলেছে। ৪৮
নারায়ণ যেদিন শেষ নাগের শয্যা ত্যাগ করবেন সেদিনই তার অভিশাপমুক্তি ঘটবে। চোখ বন্ধ রেখে আর চারটে মাস কোনোরকমে কাটিয়ে দাও। তারপর, সেই বিশেষ দিনটিতে, পরিণত শরতের জ্যোৎস্নাধারায় বিরহকালে অবদমিত সব বাসনাকে সে চরিতার্থ করবে । ৪৯
তাকে বোলো, সে আরো বলেছে, 'একদিন শয্যায় আমার কণ্ঠলগ্না হয়ে ঘুমে অচেতন আমি হঠাৎ চেচিয়ে কেদে উঠেছিলে। জেগে উঠে যখন বারবার কে দে ওঠার কারণ জানতে চেয়েছিলাম, তখন আমি মদন হেসে বলেছিলে, “লম্পট, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তুমি অন্য এক রমণীর সঙ্গে বিহাররত।” ৫০
ওগো অসিতাক্ষি, এত সব অভিজ্ঞান দেওয়ায় আমি যে কশলেই আছি তা নিশ্চয় তুমি বুঝতে পারছ। যদি কারো মখে আমার সম্বন্ধে কোনো নিন্দা শোনো তাহলেও আমার উপর বিশ্বাস হারিও না। লোকে বলে বিরহে নাকি প্রেমের ক্ষয় হয়৷ কিন্তু আমি তো দেখছি ভোগের অভাবে বিরহকালীন ইচ্ছা সঞ্চিত হয়ে হয়ে প্রেমের ভাণ্ডার আরো পূর্ণ হয়ে ওঠে। ৫১
ওগো মেঘ, প্রথম বিরহকাতরা তোমার সখিকে এভাবে আশ্বস্ত কোরো। ত্রিলো- চনের বাহন বৃষের দ্বারা উৎখাত কৈলাসশিখর থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে এসো। তবে আসার সময় এমন কোনো স্মৃতি-উপহার আর কাশল সংবাদ নিয়ে এসো যা দেখে এবং শুনে আমার জীবন রক্ষা হয়। সকালে থোকা থোকা ফল যেভাবে বৃন্তচ্যতে হয় আমার প্রাণের অবস্থাও ঠিক তেমনি। ৫২
হে সৌম্য, তোমার বন্ধুর এই সামান্য কাজটক, করে দেবার জন্য স্বীকৃত হলে তো ? অবশ্য সম্মতিসূচক কোনো উত্তর না পেয়েও আমি চিন্তিত নই। কারণ জল প্রার্থনাকারী চাতককেও তো তুমি নীরবেই জলদান করে থাক ৷ মহৎ ব্যক্তিদের ধর্মই হচ্ছে ঈস্পিত কাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমেই উত্তর দান। ৫৩
জানি, আমার প্রার্থনা নিতান্তই অনুচিত। তব, বন্ধত্বের জন্যই হোক, কিংবা বিপন্নের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শনের ইচ্ছাতেই হোক, আমার এই কাজটক, তোমাকে করে দিতেই হবে। তারপর নববর্ষার পূর্ণরূপ নিয়ে তুমি তোমার ইচ্ছে মত যেখানে খুশি যেও। প্রার্থনা করি, আমার মত তোমার জীবনে যেন কখনো বিদৎেপ্রিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদ না ঘটে। ৫৪
No comments: