এক সপ্তাহে ৩ কেজি ওজন কমাতে চান ? জেনে নিন কিটো ডায়েট কি ? এই ডায়েটে কি খাবেন , কি খাবেন না ? কি উপকার ? কি ক্ষতি ? - Keto Diet in Bengali
কিটো ডায়েট কী?
দ্রুত ওজন কমাতে সেলিব্রেটিদের প্রথম পছন্দ কিটো ডায়েট। গত দুবছর ধরে এই ডায়েটের চাহিদা বেশ তুঙ্গে। আমাদের শরীরে শক্তির মূল উপাদান হল গ্লুকোজ। শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে দেহে প্রয়ােজনীয় পরিমাণ গ্লুকোজ সরবরাহ করা হয়। দেহের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে এই গ্লুকোজ শক্তি সরবরাহ করে। এভাবে যেটুকু গ্লুকোজ দরকার তা ব্যবহৃত হওয়ার পর অতিরিক্ত অংশটুকু শরীরে জমা হতে শুরু করে। আর এভাবেই দেহে ওজন বাড়তে থাকে।
কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার বেশি খেলে শরীরে বেশি পরিমাণে ফ্যাট জমা হয়। আবার কম খেলে শরীরে প্রয়ােজনীয় ফ্যাটটুকুও থাকে না। খেয়াল করলে দেখা যায় যে, দেহের ওজন বাড়ানাের জন্য চর্বি জাতীয় খাদ্য যতটুকু দায়ী, তার থেকে বেশি দায়ী শর্করা জাতীয় খাদ্য।
কিটো ডায়েটে আসলে এই শর্করা জাতীয় খাদ্য সেবনের মাত্রা একেবারে কমিয়ে দেওয়া হয়। আর বেশি জোর দেওয়া হয় চর্বি ও প্রােটিন রয়েছে, এমন খাদ্যের উপর। কিটো ডায়েটের ক্ষেত্রে ওজন কমানাের জন্য ঘি এক কার্যকরী হাতিয়ার হতে পারে। যেহেতু ঘি ঘরের তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। তাই একে আমরা বলছি সম্পৃক্ত ফ্যাট। ঘি তৈরি হয় গােরু, মহিষের দুধ থেকে। ১০০ গ্রাম ঘিতে থাকে ১০০ গ্রাম ফ্যাট। তাই যিনি কিটো ডায়েট মেনে চলছেন তাঁকে ৭০ গ্রাম ঘি প্রতিদিন খেতেই হবে।
কিটো ডায়েট কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েট হিসেবে পরিচিত। ফলে এই ডায়েট প্ল্যানে কার্বোহাইড্রেটের পরিবর্তে বেশি করে প্রােটিন এবং ফ্যাট জাতীয় খাবার খেতে বলা হয়। একটানা অতিরিক্ত প্রােটিন খেলে লিভারে কিটোন উৎপন্ন হয়। রােজ আমরা ভাত বা রুটি থেকে যে কার্বোহাইড্রেট খাই তা থেকে তৈরি হয় গ্লুকোজ। আর প্রত্যেক দিন যে কাজ করি তার জন্য প্রয়ােজনীয় শক্তি আসে শরীরে থাকা গ্লুকোজ থেকে। যখন দেহে শর্করার পরিমাণ কমে যায় তখন শক্তি পাওয়ার জন্য শরীরে ভাঙতে শুরু করবে আমাদের ফ্যাট সেলগুলাে। এই ফ্যাট সেলগুলাে যত ভাঙবে শরীরে ততই তৈরি হতে থাকবে ফ্যাটি অ্যাসিড। আর এই ফ্যাটি অ্যাসিডই লিভারে এসে তৈরি করবে কিটোন বডি। এই পুরাে প্রক্রিয়াটাকেই কিটোসিস বলা হয়। কিটোজেনিক ডায়েটের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ২৫ শতাংশ প্রােটিন এবং ৭০ শতাংশ ফ্যাট জাতীয় খাবার রাখা হয় ডায়েটে। ট্রাইগ্লিসারাইড এবং কোলেস্টেরলের সমস্যা না থাকলে এই ডায়েটের পরামর্শ দেওয়া হয়।
লাে-ফ্যাট ডায়েটের তুলনায় এই ডায়েটে বেশি ওজন কমানাে যায়। এই ডায়েট শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে খিদে কমে যায়। এভাবে শর্করা না পেয়ে দেহ অতিরিক্ত চর্বি পােড়াতে শুরু করে এবং আমাদের ওজনও দ্রুত হ্রাস পায়। এমন ডায়েট সূক্ষ্মভাবে অনুসরণ করলে মাত্র দুই সপ্তাহেই ওজন কমানাে সম্ভব। তবে এর জন্য যেমন খাদ্যের ব্যাপারে বেশ কড়া নিয়ম পালন করতে হয়, সেটাই এর বেশ কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও রয়েছে। তাই যাঁরা বিভিন্ন রােগে আক্রান্ত, তাঁদের ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত নিজে নিজে এমন ডায়েট অনুসরণ করা উচিত নয়।
কিটো ডায়েটে যা যা খাওয়া যায় ?
সব ধরনের মাংস পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যাবে। সকল প্রকার মাছ, বিশেষ করে প্রচুর চর্বি বা তেল রয়েছে, এমন মাছ খাওয়া ভালাে। খাদ্য তালিকায় মাখন ও ঘি যােগ করা যায়। রান্নায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার না করে ঘি ব্যবহার করা যেতে পারে। কিটো ডায়েটের খাদ্য তালিকার এক প্রধান খাবার হল ডিম। মাখন ও ঘি ছাড়াও পনির খাওয়া যাবে। সকল প্রকার বাদাম ও বাদাম থেকে তৈরি অন্যান্য খাদ্য, যেমন পিনাট বাটার খাওয়া যাবে। খাদ্যে সয়াবিন তেলের পরিমাণ একেবারে কমিয়ে দিতে হবে। আর সয়াবিনের পরিবর্তে রান্নার জন্য ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্রিম, পনির, আখরােট, স্যালাড, চিজ, নারকেল তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি বেশি খেতে হবে।
কিটো ডায়েটে কী কী খাওয়া যাবে না ?
ভাত বাদ দিলে সবার আগে রুটি খাওয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় আসবে। তবে চাল, আটা, ময়দা দিয়ে তৈরি সকল খাবারে প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ থাকে। তাই আটা ও ময়দা দিয়ে তৈরি খাদ্য, যেমন-রুটি, পাস্তা, সিরিয়াল ইত্যাদি খাবার বাদ দিতে হবে। গম, ভুট্টা, চা, ডালিয়া, চিনি একদম খাওয়া যাবে না। ডাল, মটর এবং অন্যান্য দানা জাতীয় শস্য খাওয়া যাবে না। সব রকম ফলমূল খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। এটা সত্যি যে, অনেক ডায়েটে ফল খাওয়ার পেছনে জোর দেওয়া হয়। ফলে প্রচুর পরিমাণে চিনি বা গ্লুকোজ থাকে। তাই ফল খাওয়াও কমিয়ে দিতে হবে। ফলের মধ্যে বাদ দিতে হবে কলা, আপেল, কমলালেবু। এছাড়াও সজির মধ্যে বাদ থাকবে আলু।
কিটো ডায়েটের উপকারিতা কি ?
ওজন কমাতে এই ডায়েটের জুড়ি নেই। এছাড়াও ওজন কমতে শুরু করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়। পিসিওএস, সুগার, স্থূলতা এসব থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কিটো ডায়েটের অপকারিতা কি ?
এই ডায়েট সবার জন্য নয়। এতে ধমনীর গায়ে ফ্যাট জমে। হার্ট ব্লক হয়ে যায়। তার থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কিটোজেনিক ডায়েট স্বল্প সময়ে ওজন কমানাের জন্য বেশ কার্যকরী হলেও এটি দীর্ঘ সময় ধরে অনুসরণ করা উচিত নয়। অনেকদিন ধরে এই খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে কিডনিতে পাথর, রক্তে প্রােটিনের আধিক্য, শরীরে খনিজ উপাদান ও ভিটামিনের অভাব এবং যকৃতে চর্বি জমতে পারে। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি কিটো ডায়েটের কারণে ‘কিটো ফু’ নামক এক বিশেষ রােগ হয়। ক্লান্তি, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য হবে, মাথা ঘােরার মতাে সমস্যা দেখা দেবে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে ও ইনসুলিনের উপর নির্ভর করতে হয়, কিডনির রােগ, ইটিং ডিজঅর্ডার রয়েছে তাদের জন্যও কিটো ডায়েট উপযুক্ত নয়। তাই নিজ উদ্যোগে এ ডায়েট শুরু না করাই ভালাে। এটি শুরুর আগে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অথবা একজন ডায়েটিশিয়ানের সঙ্গে আলােচনা করা উচিত।
কিটো ডায়েট ডেকে আনতে পারে ফ্যাটি লিভার। হাইপো পােপ্রােটেনিয়া হতে পারে। ডেনসিটি লাইপােপ্রােটিন কোলেস্টেরল বাড়ায়। হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়, টাইপ টু ডায়াবেটিস হয় কিটো ডায়েটের ফলে কিটোসিস হতে পারে। আমাদের মস্তিষ্ক গ্লুকোজকে অনুসরণ করে। গ্লুকোজ না পেলে ব্রেন স্টোক পর্যন্ত হতে পারে। একে বলে কিটোসিস। সম্প্রতি কিটো ডায়েটের বলি হয়েছেন এক বাঙালি অভিনেত্রী। বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। কিডনির অসুখ নিয়ে ভর্তি হন তিনি। সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। এই ডায়েটে মাসলের শক্তিক্ষয় হয়। যার প্রভাব সরাসরি পড়ে হার্টে। প্রচুর ফ্যাট হার্টে ট্রাইগ্লিসারিন জমায়, ফলে হৃদযন্ত্র ব্লক,ইসকেমিয়ার মতাে রােগে মৃত্যু হতে পারে। কিটো ডায়েট এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত মেনে চলা যায়। কিন্তু দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে কিটো ডায়েট কখনওই কাম্য নয়। শরীরের শক্তি আসে ক্যালােরি থেকে। হঠাৎ কম ক্যালােরি খেলে শরীরের পেশির উপর প্রভাব পড়ে। পেশির শক্তি ক্ষয় হয়। শুধু তাই নয়, দেহে সঠিক মাত্রায় ভিটামিন আর মিনারেলের অভাবে ত্বকের উজ্জ্বলতা হারিয়ে যায়। চুল পড়ে যায়।
কিটো ডায়েটে ঘি খাওয়া যাবে ?
ঘি অল্প খাওয়া যেতে পারে কারণ ঘি-তে থাকা কোলেস্টেরল পুরুষদের টেস্টোটেরন হরমােন নিয়ন্ত্রণ করে, পিত্ত থলির কার্যকরিতা বাড়ায়। কিন্তু অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হিমােগ্লোবিন বাড়ায়, শরীরে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স বাড়ায়। এগুলি সবকটিই অতিরিক্ত ভালাে নয়। যাঁরা খেলােয়াড় তাঁরা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। তবে কোনও পুষ্টি বিশেষজ্ঞই অনেকদিন কিটো ডায়েট চালাতে বলবেন না। তিনি রােগীর রক্ত পরীক্ষা করে শরীরের প্রয়ােজন অনুযায়ী ফ্যাট গ্রহণের মাত্রা ঠিক করে দেবেন। তবে সাবধান! অতিরিক্ত যে কোনও কিছুই কিন্তু ক্ষতিকর। তাই ওজন কমানাের চক্করে বেশি বেশি ঘি খেলেই কিন্তু বিপদে পড়তে হতে পারে। রােজ ঘি খেতেই পারেন। কিন্তু সামান্য পরিমাণে। ঘি দিয়ে যদি দেহের ওজন কমাতে হয়, তাহলে। ডায়েটিশিয়ানের পরামর্শ নিন। সঠিক ডায়েট আপনাকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালির খাদ্যাভ্যাস আর কিটো ডায়েটের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। চাল-ডাল ও আটাময়দা মিলিয়ে আমরা দৈনিক প্রচুর কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করি। কাজেই কিটো ডায়েট শতভাগ অনুসরণ করা অনেক কষ্টকর একটা ব্যাপার। তাই এই খাবারগুলাে একেবারে পরিত্যাগ না করে বরং তার পরিমাণ কমিয়ে আনা উচিত। তাছাড়া আমরা যেভাবে অতিরিক্ত তেল দিয়ে মাছ-মাংস রান্না করি, তাও খুব স্বাস্থ্যকর নয়। কাজেই সবকিছুর মাঝে ভারসাম্য রেখে পুষ্টিবিদদের সহায়তায় একটি ডায়েট চার্ট তৈরি করে তবেই ওজন কমানাের মতাে প্রক্রিয়ায় নামুন।
No comments: