কুণ্ডলিনী শক্তি কি?
কুণ্ডলিনী হল বিশ্বপ্রাণশক্তির ব্যক্তিগত দিক। যোগ ব্যবস্থায় একে 'প্রাণ' নাম দেওয়া হয়েছে। ভারতে যাকে কুগুলিনী বলে চীনে তাকেই বলা হত “চি” জাপানে “কি” খ্রীষ্টান ধর্মে Holy Spirit এই Holy Spirit হল আমাদের আদ্যাশক্তির মতো। এই প্রাণশক্তিই জগতের সবকিছু কার্য-কারণের উৎস। প্রাচীন ঋষিরা মনে করেন যে, মানুষের চিতশক্তিকে এই শক্তিই উন্নততর অবস্থায় নিয়ে যায় । এই শক্তির বলেই মানুষ জ্ঞানদীপ্ত হয়। মানুষের বিশ্বচৈতন্য জাগ্রত হয়। সমাধি হয়।
কুণ্ডলিনী চক্র বা এই শক্তি প্রকৃত পক্ষে কি?
ভারতের এক যােগী, তিনি কুণ্ডলিনী সম্পর্কে বলেছেন যে, কুণ্ডলিনী কি? কুণ্ডলিনী মাংসগ্রন্থি ও নাড়ির মধ্যে যােগাযােগ ঘটিয়ে রক্তপ্রবাহের ধারাটিই পাল্টে দেয়। এতে দেহে রাসায়নিক পরিবর্তনও ঘটে। ফলে স্নায়ুগ্রন্থি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। এতে মস্তিষ্ক-স্নায়ু নানা ধরনের সংকেত ধরতে পারে, সেগুলিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। কি কারণে কি ঘটছে তা সহজে বুঝতে পারে। এক কথায় মানুষ সামগ্রিকভাবে সচেতন হয়ে ওঠে। এই কারণে কুণ্ডলনী-যােগকে একে চিৎশক্তির যোগ বলা হয়। নদী যেমন সমুদ্রে গিয়ে যাত্রা শেষ করে তেমনি যােগের শেষ হয় কুণ্ডলিনীর জাগরণ ঘটিয়ে।
তাহলে সহজ কথায় এই কুণ্ডলিনী কি?
কুণ্ডলিনী হলেন মানুষের সৃজনশীল মৌলশক্তি। কুণ্ডলিনী জাগরণে মানুষের দেহ-মনের ভেদ মুছে যায়। ফলে জগতের চিৎশক্তির দিকে মানুষের ক্রমবিকাশ ঘটে।
কুণ্ডলিনী যোগের ইতিহাস কি ? কোথায় সৃষ্টি হয়েছিল ?
কুণ্ডলিনী-যােগ হল ভারতের সৃষ্টি। বর্তমানে দেশের সীমানা পাড় হয়ে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে আমেরিকাতে।
কুণ্ডলিনী যোগ করলে কি উপকার হয় ?
এই যােগ থেকে উচ্চস্তরীয় আত্মিকশক্তির বিকাশ ঘটে। রীতিমত এই যােগ করলে, ধ্যান করলে দেহ-মনের সম্পর্ককে তখন নতুন চোখে নজরে পড়ে। এইদিক থেকে দেখতে গেলে একে বলা যায় Bioenergetics । বিশেষ ধরনের আত্মিক ভাবাবেগকেও এর দ্বারা বােঝা যায়। মানুষ আত্মিক স্তরের কোন্ পর্যায়ে আছে এর দ্বারা তাও স্পষ্ট হয়ে যায়।
তবু পাশ্চাত্যে এ ব্যাপারে যে ধারণা আছে ভারতীয় কুণ্ডলিনী ঠিক তেমনটি নয়। প্রাচীনকালে এই যােগের উদ্ভাবকেরা দেহ-মনের সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের ক্রমবিকাশকে বুঝিয়েছেন। দেহ-মনের সম্পর্কে যােগের ধারণা বিজ্ঞানীরাও আজ স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য ভারতবর্ষে এ-ক্ষেত্রে যে পূর্ণ বােধবিজ্ঞান আছে তার সবটাই তাঁরা ধরতে পারেননি। তবুও যতটুকুই বুঝেছেন তার দ্বারাই নানা ধরনের Psychosomatic medicine তৈরি করেছেন। তবু দেহ-মনের সম্পর্ককে সঠিক ভাবে ধরতে পারেননি। এই কুণ্ডলিনীশক্তিই ঈশ্বর। এই জন্যই বলা যায় যে, অতিমানবদের কাছ থেকে ঈশ্বর খুব দূরে থাকেন না। তিনি মানুষের ভেতরে থেকেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বিজ্ঞান জীবনপ্রবাহের সঙ্গে অত্যন্ত নিকটভাবে যুক্ত। তবে এই প্রবাহ যেখান থেকে সৃষ্ট হয়েছে সেই মহাবৈশ্বিক চেতনার স্থানটি আজও সঠিক ভাবে ধরে উঠতে পারেনি। ফলে অধ্যাত্মজগৎ থেকে কিছুটা নেমে এসে নিজেকে বস্তুবাদ, কারিগরি কলাকৌশল ইত্যাদির মধ্যে নামিয়ে এনেছে। যথার্থ যে জ্ঞান সেই জ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে নিজেকে যুক্ত করতে পারেনি। মনে রাখতে হবে যে, যােগ ব্যাপারটা তত্ত্ব দাঁড় করানাের মধ্যে নেই। যােগ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান তখনই হয় যখন নিজে কেউ যােগ করে। তবুও ভুলভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বিজ্ঞানের পশ্চাৎপটে একে বিচার করে দেখলে ভালই হয়।
কুণ্ডলিনী শব্দের অর্থ কি ?
যােগের সঙ্গেই কুণ্ডলিনী শব্দটি যুক্ত। তবুও কুণ্ডলিনী-যােগ সাধারণ যােগ অপেক্ষা একটু ভিন্ন। কুণ্ডলিনী-যােগ হল যােগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা।
কুণ্ডলিনী অর্থ বুঝতে হলে শক্তির সঙ্গে একে যুক্ত করে নিতে হবে। শব্দটি এসেছে কুণ্ডল শব্দ থেকে। এর অর্থ পেঁচিয়ে থাকা। কুণ্ডলায়িত হয়ে থাকা। সাপ পেচিয়ে থাকে বলেও এই শক্তিকে কুণ্ডলিনী বা কুণ্ডলিনী-শক্তিকে সাপ বলা হয়েছে। শক্তি শব্দটি এসেছে ‘শক’ থেকে। শক মানে ক্ষমতা বা শক্তিশালী হওয়া। এই দুটি শব্দকে (কুণ্ডলিনী ও শক্তি) একত্র করে এইজন্য বলা হয় কুল (শক্তি, দ্রাবিড়)—কুণ্ড (গর্ত, দ্রাবিড়)—লিনী।
প্যাচানাে ভঙ্গীতে সাপের মতাে ঘুমিয়ে আছে এই প্রতীকেই কুণ্ডলিনী-শক্তিকে দেখানাে হয়। এই প্যাচানাে ভাবটা কেন? ঘুমানাে ভাবটাই বা কেন? এটা বুঝতে হলে তান্ত্রিক দর্শনের গােড়ায় যেতে হবে। ভারতের প্রাচীন দর্শন মতে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শুদ্ধ চিৎশক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকাশ করার পর এই শক্তি নিজেকে বিভক্ত করে দুই মেরুপ্রান্তে বিরাজ করছে। এই দুই ভাগের কেউই একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারে না। এর একটা অংশ স্থির থাকে। এই অংশটি অপ্রকাশিত চিৎশক্তি। তন্ত্রে এই অপ্রকাশিত অংশকে বলা হয় শিব। শিব হলেন পুরুষের প্রতীক। শিবকে নিবিড় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখা যায়। বিশ্ব-প্রকাশে তার কোন আগ্রহ ছিল না। শিবের ভিতরই শক্তি রয়েছেন। ইচ্ছা করলেই তিনি রূপান্তর ঘটাতে পারেন। কিন্তু শিব নিজে কোন রূপান্তর ঘটান না। কাজ করার তার কোন ক্ষমতাই নেই। তিনি শক্তিমান। কিন্তু এই শক্তিকে ব্যবহার করার তার ক্ষমতা নেই। শক্তির আর একটি দিক হল গতিময়। এই গতিময় শক্তিই কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে। এই গতিময় শক্তিই শক্তির অপ্রকাশিত অংশে থাকেন। এই গতিময় অংশকেই বলে শক্তি। তিনিই বিশ্বপ্রসবিনী। এই শক্তি হল অতি সূক্ষ্ম প্রবাহ। সেই অবস্থা থেকে বিশ্ব প্রসব করেছেন। এই বিশ্বের মধ্যেই রয়েছে বস্তু, প্রাণ, মন ইত্যাদি। শক্তির এই দুই মেরুপ্রান্তিক অবস্থা যথার্থ অর্থে ধরতে গেলে পরস্পর যুক্ত।
কিন্তু প্রকাশিত বিশ্বে ভ্রান্তিবশতঃ আমরা একে পৃথক করে দেখি। নির্ভেজাল চিৎশক্তি থেকে প্রকাশিত শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রূপে বেরিয়ে আসে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে নির্ভেজাল চৈতন্য থেকে বেরিয়ে আসে—চিৎশক্তিকে সেই-ই আড়াল করে রাখে। এই প্রকাশিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই মায়া-স্বরূপ। শাস্ত্রমতে কর্ম পরিপক্ক হলেই চিৎশক্তি সৃষ্টির জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এবং নিজেকে নিজসৃষ্ট মায়া দ্বারা আবৃত করে। এই যে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয় একেই বলে কুণ্ডলিকরণ। এর ফলেই সবকিছু জটিল হয়ে ওঠে। মেরুপ্রান্তিক হয়। কোটি কোটি বছর পরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যখন লয়প্রাপ্ত হয়, যে শক্তি থেকে তার সৃষ্টি হয়েছিল সেখানেই সে আবার ডুবে যায়। একেই বলে ক্রমবিকাশ। এখানে নির্ভেজাল চিৎশক্তি ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আর কোন। ভেদ থাকে না। পদার্থবিদ্যা থেকে জানা যায় যে, শক্তি দু’ভাবে থাকে, যেমন (১) গতিময় ও (২) ঘুমন্তশক্তি। শক্তি যেভাবেই কাজ করুক না কেন তার একটি স্থির পশ্চাৎপট থাকেই। চিৎশক্তি যখন সৃজনশীল হয়ে ওঠে তখনই দুটি মেরুপ্রান্তিক অবস্থাতে ভাগ হয়ে যায়। বিশ্বপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নির্ভেজাল শক্তির কিছুটা অংশ এই গতিময় বিশ্বের সঙ্গ নেয়। তবে এর অধিকাংশই প্রচ্ছন্ন থাকে। সমুদ্রের জলে এ হল আইসবার্গের মতাে। ভাসমান এই আইসবার্গের অধিকাংশই থাকে দৃষ্টির বাইরে জলের নীচে। এই অধিকাংশের শক্তিই কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে। এই কুণ্ডলিনী শক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভিত্তি স্বরূপ। ভারতীয় তন্ত্রমতে মানুষ হল ক্ষুদ্র বিশ্বস্বরূপ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু দেখা যায় তার সবই থাকে স্বতন্ত্র অবস্থার মধ্যেও। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে নিয়মকানুন চলে তার সবই স্বতন্ত্র সত্তার মধ্যেও প্রচলিত। মানুষের দেহেও অনেকখানি শক্তি অব্যবহৃত থাকে। এই অব্যবহৃত শক্তিই কুণ্ডলিকৃতা অবস্থায় থাকে বলে বিশ্বাস। একেই কুণ্ডলায়িতা শক্তি হিসেবে ধরা হয়। তাই এর নাম কুলকুণ্ডলিনী অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন শক্তি।
এই শক্তি প্রচ্ছন্ন থাকে মানব দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানে। যে স্থানে থাকে তাকে বলে মূলাধার চক্র। সমগ্র মানবদেহের সকল কাজকর্মের ভিত্তিই হল এই শক্তি। এই কুণ্ডলিনীকে ঘিরেই সমগ্র মানব-দেহ ঘুরছে। যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরছে আদি শক্তিকে কেন্দ্র করে। মানুষের দেহে কুণ্ডলিনী হলেন দিব্য মহাবৈশ্বিক শক্তি। মানবদেহে যে গতিময় শক্তি কাজ করে শক্তির ক্রিয়াশীল অবস্থা থেকে তার প্রকাশ ঘটে। শক্তির এই ক্রিয়াশীল অবস্থাকেই বলে প্রাণ। যান্ত্রিক তেজ থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি অনেক সূক্ষ্ম। এই শক্তিকে আমরা দীর্ঘদিন ব্যবহার করে চলেছি।
প্রায় দু'তিনশ বছর। এর আগে এই বিদ্যুৎ-শক্তি সম্পর্কে লােকের কোন ধারণাই ছিল না। প্রাণশক্তি সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযােজ্য। প্রাণশক্তি এই বিদ্যুৎ-শক্তি অপেক্ষা আরও সূক্ষ্ম। আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাণশক্তির কোন পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। তবে ভারতের যােগশাস্ত্র কিন্তু এই প্রাণ নিয়ে বিস্তর আলােচনা করেছে। দেহের নানা ধরনের কাজকর্মের সঙ্গে প্রাণশক্তিও নানাভাবে বিভক্ত। মানুষের দেহের সূক্ষ্ম নাড়ি দিয়ে এই প্রাণশক্তি প্রবাহিত, ঘরের দেয়ালে যেমন বৈদ্যুতিক শক্তিবাহী তার দিয়ে বিদ্যুৎ-শক্তি চলাফেরা করে। এই প্রাণশক্তিই দেহ ও মনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। মানবদেহের কোষগুলিকে সঞ্জীবিত রাখে এই প্রাণশক্তিই। শক্তির প্রাণরক্ষাকারী প্রবাহ মানবদেহের কয়েকটি কেন্দ্রকে ভিত্তি করে কাজ করে। এই কেন্দ্রগুলি যে বস্তুসাত্তিক কোন কেন্দ্র তা নয়। তবু মানবদেহের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে এর যােগাযােগ রয়েছে। একেই বলে চক্র অর্থাৎ শক্তিকেন্দ্র। এই চক্রগুলি হল শক্তির আবর্ত বিশেষ। এগুলিই মানবদেহের সংগঠনকে সুশৃঙ্খল করে রাখে। তবে এই কেন্দ্রগুলিকে চর্মচক্ষুতে দেখা যায় না। এমনকি যন্ত্রের সাহায্যেও নয়। এই চক্রগুলি দেহের বিভিন্ন অংশকে নিয়ন্ত্রিত করে। মানব-চৈতন্য কোথায় কোন্ অবস্থায় আছে চক্রগুলির সাহায্যেই তা বলে দেওয়া যায়। এক একটি চক্রে চিৎশক্তির উপস্থিতি অনুযায়ী মানুষের বিশ্বজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান হয়। বিভিন্ন চক্রে শক্তির (কুলকুণ্ডলিনীর) উপস্থিতি অনুযায়ী ভিন্নজনে ভিন্নভাবে এই বিশ্বকে দেখে থাকেন। ধরা যাক শক্তি যদি স্বাধিষ্ঠান চক্রে থাকে তাহলে মানুষের মধ্যে ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির দিকে ঝোঁক যায়। অনাহত চক্রে এই শক্তি উঠলে মানুষের মধ্যে একটা আকর্ষণীয় ভাব জন্মে। মানুষ দয়ার্দ্রচিত্ত হয়। অপরের প্রতি করুণা প্রদর্শন করে ইত্যাদি।
কুণ্ডলিনী চক্রর অবস্থান মানবদেহের নিম্ন দিকে থাকে উপরের ছবির মতো ।
- তথ্যসূত্র - কুলকুণ্ডলিনী কথা - স্বামী নিগুঢ়ানন্দ
No comments: