অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানী
• অতুল ঐশ্বর্য দিযে ভর্তি করা স্মৃতির এই যে গোপন গৃহ এর দ্বারে সেপাই সান্ত্রীর পাহারা নেই। কিন্তু মন্ত্র দিয়ে বন্ধ করা এর প্রবেশ পথ, ভিতর থেকে খোলে দুয়ার এ ঘরের নিজের মনের হুকুমে; বাইরে থেকে খোলে মনের মানুষ যদি যায় তবে।'
• জগত শুধু মায়া কি শুধু কায়া নিয়ে চলছে না, এই দুইয়ের সমন্বয়ে চলছে।
• শিল্প হচ্ছে শখ। যার সেই শখ ভিতর থেকে এল সেই পারে শিল্প সৃষ্ট করতে, ছবি আঁকতে, বাজনা বাজাতে, নাচতে, গাইতে, নাটক লিখতে-যাই বলো।
• খেলার সময় যেমন তাসগুলো হাত বদল করে তেমনি এই রূপ সৃষ্টির লীলা খেলাতে নিয়তির নিয়মগুলি আসা-যাওয়া করে আরিস্টের হাতে বার-বার। এই নিয়ম সমস্ত জানার জন্যই Nature Study করতে হয় আটিস্টকে, না হলে শুধু নিজের নিয়মে চললে খেলা চলে ঘুরে ফিরে অনেক্ষণ।, র
• ফটোগ্রাফের সঙ্গে ফটোকর্তার যোগ পুরো নয়_পাহাড় দেখলেম ক্যামেরা খুললেম, ছবি উঠল, ফটোকর্তার অন্তরের সঙ্গে পাহাড়ের যোগাযোগই হল না। এই জন্য আর্টিস্টের লেখা পাহাড় যেমন মনে গিয়ে পৌঁছায়, ফটোতে লেখা পাহাড় ঠিক তেমনভাবে মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না-_শুধু চোখের ওপর দিয়েই ভেসে যায় বায়োস্কোপের ছবি, মনের মধ্যে তলিয়ে যায় না।
• মন যৌবনের শেষ চাইল না, নতুন থেকে নতুনতর আনন্দে আপনাকে ' হারিয়ে ফেলেই চলল, এই হল রূপদক্ষের কথা, রূপ সাধনার চরম্ সিদ্ধি ।
• আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনমতকে সুন্দরই দেখি । কারু কাছ থেকে ধার-করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাবো তার উপায় নেই।
• এতিহাসিকের কারবার নিছক ঘটনাটি নিয়ে, ডাক্তারের কারবার নিখুঁত হাড়মাসের অ্যানাটমি নিয়ে , আর আর্টিস্টের কারবার অনির্বচনীয় অখন্ড রসটি নিয়ে ।
• নেপোলিয়ান বির রসের আর্টিস্ট । তাঁর হাতে হাতে ইউরোপের ইতিহাস সৃষ্টি হলো , সীজাপ আর্টিস্ট গড়ল রোমের ইতিহাস ।
• হৃদয়কে কেবল আপনার করে রাখলে নিজেই ঠকি , হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মেলানোতেই রস পাই । সুতরাং বলতে পারি যে , রস হলো দুইটিকে মিলিয়ে সেতু , রুচী হলো দুইটিকে পৃথক করে প্রাচীর ।
• লাবণ্য তাে অনুভব করি এবং চোখেও দেখি একসঙ্গে, অথচ জিনিসটা এমনই যে পাকাপাকি একটা ব্যাখ্যার মধ্যে ধরাছোঁয়া দিতেই চায় না।
• শিল্পের একটা মূলমন্ত্রই হচ্ছে ‘নালমিতিবিস্তরণে’। অতি বিস্তারে যে অপর্যাপ্ত রস থাকে, তা নয়। অমৃত হয় ফোঁটা, তৃপ্তি দেয় অফুরন্ত।
• উৎসবের রঙ শােকের রঙ এ সবই ধার করে নিয়েছে মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে কোনাে আদিকাল তার ঠিকানা নেই।
• মানুষ বিশ্বের আকৃতির প্রতিকৃতি নিজের রচনায় বর্জন করল বটে, কিন্তু প্রকৃতিটি ধরলে অপূর্ব কৌশলে যার দ্বারা রচনা দ্বিতীয় একটা সৃষ্টির সমান হয়ে উঠল। একটা কিছুতেই লাভ করতে পারে না সেই মানুষ যে এই বিশ্বজোড়া রূপের মূর্ত দিকটার খবরই নিয়ে চলেছে, রসের অমূর্ততা মূর্তকে যেখানে মুক্ত করেছে সেখানের কোনাে সন্ধান নিচ্ছে না, শুধু ফটোযন্ত্রের মতাে আকার ধরেই রয়েছে, ছবি ওঠাচ্ছে মাত্র, ছবি ফোটাচ্ছে না।
• শিল্পশাস্ত্র খুবই গভীর, তার একটা লাইনের অর্থ হাজার রকম, কিন্তু তার চেয়ে গভীর জিনিস হল শিল্প, যার একটা লাইনের মর্ম ঝুড়ি ঝুড়ি শিল্পশাস্ত্রেও কুলােয় না, আবার শিল্পের চেয়ে গভীর হল শিল্পীর মন—যার মধ্যে বহির্জগৎ তলিয়ে রইল—স্মৃতির শক্তিতে ধরা মুক্তি, নতুন জগৎ সৃষ্টি হল জলের মাঝে বাড়বানল। এই যে শিল্পীর মন এর কাজই হল বাইরে গিয়ে আবিষ্কার, এবং ভিতরে থেকেও আবিষ্কার...
• সুন্দরের রূপ ও তার লক্ষণাদি সম্বন্ধে জনে-জনে মতভেদ কিন্তু সুন্দরের আকর্ষণ যে প্রকাণ্ড আকর্ষণ এবং তা আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে নিগুঢ়ভাবে জড়ানাে সে বিষয়ে দুই মত নেই।
• গানের সুর সম্পূর্ণ কাল্পনিক জিনিস কিন্তু এই বাস্তব জগতের বায়ুতরঙ্গের ওপর তার প্রতিষ্ঠা হল, কথার ছবির সঙ্গে সে আপনাকে মেলালে তবে সে সঙ্গীত হয়ে উঠল।
• মৌচাক আর বােলতার চাক—সমান কৌশলে আশ্চর্যভাবে দুটোই গড়া। গড়নের জন্য বােলতার আর মৌমাছিতে পার্থক্য করা হয় না; কিংবা মৌমাছিকে মধুকর নাম দেওয়া হয় না—অতি চমৎকার চাকটার জন্যে। মৌচাকের আদর, তাতে মধু ধরা থাকে বলেই তাে ! তেমনি শিল্পী আর কারিগর দুয়েরই গড়া সামগ্রী, নিপুণতার হিসেবে কারিগরেরটা হয়তাে বা বেশি চমৎকার হল, কিন্তু রসিক দেখেন শুধু গড়নটা নয়, গড়নের মধ্যে রস ধরা পড়ল কি না। এই বিচারেই তাঁরা জয়মাল্য দেন শিল্পীকে, বাহবা দেন কারিগরকে। শিল্পীর কাজকে এই জন্যে বলা হয় নির্মিতি অর্থাৎ রসের দিক দিয়ে সেটি মিত হলেও অপরিমিত। আর কারিগরের কাজকে বলা হয় নির্মাণ অর্থাৎ নিঃশেষভাবে পরিমাণের মধ্যে সেটি ধরা।
• ভাবুক যাঁরা, সচরাচর যান্ত্রিক দৃষ্টি যাঁদের নয়, তাদের পক্ষে সহজ হয় শিশুদের মতাে হৃদয় দিয়ে আত্মীয়ভাবে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে পরিচয় করে নিয়ে বিশ্বের গােপন কথা বলা। মানুষ জানে সে নিজে অপূর্ণ, তাই পরিপূর্ণতার দিকে যাওয়ার ইচ্ছা তার এতখানি। গ্রিস, ভারত, চিন, ঈজিপ্ট সবাই দেখি পরম সুন্দরের দিকে চলেছে, কিন্তু সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা কেউ পায়নি, কেবল পেতে চাওয়ার দিকেই চলেছে।
• অসাধারণ ভাবপ্রবণতা হল মাটির মতাে, রসের ভােজে বীজে ফল ধরায়, শক্তি গজায়, ফুল ফোটায়, ফল দেয় নানা রকম। আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনমতকে সুন্দরই দেখি। কারু কাছ থেকে ধার করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাব তার উপায় নেই।
• ছবিতে মূর্তিতে কবিতায় গানে শুধু ফুটন্ত রূপ নিয়ে কারবার নয়, আর্টিস্টের দেখা, —দেখা দুই রূপ মিললে তবে ছন্দোময় হয় কাজ।
• সৃষ্টির নিয়মে সমস্ত সুন্দর জিনিস আপনার নির্মাণের কৌশল লুকিয়ে চলল দর্শকের কাছ থেকে এবং এই নিয়মেই মেনে চলল সমস্ত সুন্দর জিনিস যা মানুষ রচনা করলে - যেখানে নির্মাণের নানা প্রকরণ ও কৌশল ধরা পড়ে গেল সেখানেই রচনার সৌন্দর্যহানী হলো , কালের দিক ফুটলো , কিন্ত রসের দিক , সৌন্দর্যের দিক চাপা পড়ে গেলো ।
• রচনা যেখানে রচয়িতার স্মৃতি ও কল্পনার কাছে ঋণী সেইখানেই সে আর্ট ।
• যে ভাষাই ব্যাবহার করি না কেন , মনের হাতে তাঁর লাগাম তুলে না দিয়ে তাকে চালিয়ে যাওয়া শক্ত ।
Tags: quotes by abanindranath tagore, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর , abanindranath tagore in bengali , অবনীনন্দ্রনাথ ঠাকুরের বানী , আর্ট নিয়ে বানী , অবনীন্দ্রননাথ কে
No comments: