মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী
" ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল।"
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রাত্য জনের সুখদুঃখ-স্বপ্ন-নিরাশা-শপথ-তামাসা তার রচনায় যে ভাবে যে গভীরতায় ফুটে উঠেছে, অন্য কোনও বাঙালী ঔপন্যাসিকের সৃষ্টিতে তেমনটি যেন আমরা খুঁজে পাই না।
নিজের সাহিত্যসৃষ্টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,
" ভাবপ্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ সাহিত্যে আমাকে বাস্তবকে অবলম্বন করতে বাধ্য করেছিল।"
প্রকৃতপক্ষেই মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিটি রচনায় যে নির্যাস নিহিত, সেখানে ভাবালুতার স্থান নেই।
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ২৯শে মে, ১৯০৮। স্থান দুমকা, সাঁওতাল পরগনা। বাবার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। মা নিরদাসুন্দরী। পবিরবারটি এসেছিল ঢাকার বিক্রমপুর থেকে।
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃদত্ত নাম প্রবােধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য রচনায় তিনি মাণিক নামটি ব্যবহার করেন। হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সরকারী চাকুরে। সে কারণে তাকে প্রায়শই বদলি হতে হত। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাবা-মার সঙ্গে অনেক জায়গা ঘুরেছেন। বিবিধ পরিবেশে নানান শ্রেণীর নরনারী দেখেছেন—যারা তাঁর গল্প ও উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। শােষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধচারণ করেছে তার বলিষ্ঠ লেখনী।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কৃষ্ণবর্ণ আর অসম্ভব দুঃসাহসী । কোনোকিছুতেই ভয় ছিল না তাঁর । ছোটবেলাতে একবার খেলতে খেলতে আঁশবটিতে পেট কেটে ফেলেন , একবার জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে পা পুড়িয়ে ফেলেন আর একবার বারুদ দিয়ে বাজি বানাতে গিয়ে ভীষণ ভাবে আহত হয়ে পড়েন , তবু তিনি তাঁর দস্যিপানা ছাড়েননি । কৈশােরে ছিলেন মেদিনীপুরে। মেদিনীপুর জিলাস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশন কলেজ থেকে আই.এস. সি পাশ করেন। অঙ্কে অনার্সসহ বি.এস.সি পড়তে ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে।
প্রেসিডেন্সীতে পড়বার সময় তিনি 'অতসী মাসী’ নামে একটি গল্প লিখে সে বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা বিচিত্রা’-তে পাঠান।
গল্পটি ছাপা হয় এবং প্রথম গল্পেই মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন সাড়া তােলেন যা অতি অল্পক্ষেত্রে লেখকদের কপালে জুটে থাকে।
মাত্র একুশ বছর বয়সে লিখলেন তার প্রথম উপন্যাস ‘দিবারাত্রির কাব্য' । যথেষ্ঠ বলিষ্ঠ রচনা। লেখালেখিতে এতটাই মগ্ন হয়ে পড়লেন মাণিক
বন্দ্যোপাধ্যায় যে তার পক্ষে আর বি.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া সম্ভবপর হল না। তিনি সাহিত্যকে তার জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলেন—যা সেই সময়ে ছিল অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত। মাণিক বন্দ্যেপাধ্যায় নিজেকে কল্লোল’ সাহিত্যগােষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করেন। কল্লোল পত্রিকাকে ঘিরে তখন একদল শক্তিমান কথাসাহিত্যিক নিজেদের মেলে ধরছেন। এঁদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবােধ সান্যাল প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। তাদের সঙ্গে গিয়ে যুক্ত হলেন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে সে সময়ের সুখ্যাত পত্রিকা ভারতবর্ষ’-এ প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস ‘জননী'। সেই পত্রিকাতেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী আরও দুটি উপন্যাস—‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এবং ‘পদ্মা নদীর মাঝি' ।
দুঃখ দারিদ্রে জর্জরিত নরনারীর অমন জীবন্ত আলেখ্য এর আগে অন্য কোনও বাঙালী ঔপন্যাসিকের কলমে ফুটে ওঠেনি। অথচ ওই স্তরের অবহেলিত মানুষদের মধ্যেই রয়েছে অযত্নরক্ষিত অমসৃণ কত হীরকখণ্ড। এরকম সমস্ত আপখোেরাকী লােকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাদের জীবনযাত্রায় শামিল হতে গিয়ে তিনি নিজে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার বহুবিধ অভিজ্ঞতার মহিমা রয়েছে তাঁর রচিত প্রতিটি রচনায়। কিন্তু লিখে যথেষ্ট আয় হত না লেখকের। অথচ লেখার স্বার্থেই তিনি কোথাও চাকরিও নেবেন না। ভালাে বেতনের চাকুরি গ্রহণে অস্বীকার করেছেন। অর্থাভাবে যখন ধুকছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে কিছু বৃত্তি দেবার ব্যবস্থা করেন ।
লেখক জীবনের দ্বিতীয়ার্থে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কসবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ফলে ভাববাদের আরও বিরােধী হয়ে উঠলেন। কিছু ক্ষেত্রে তাঁর রচনা খানিক শ্লোগানধর্মীও হয়ে ওঠে। তবে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকাংশ রচনাই বাংলা সাহিত্যের মহামূল্য মণিরত্ন। তার ছােটোগল্পগুলিও অনন্য। আর উপন্যাসগুলির মধ্যে পদ্মা নদীর মাঝি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ‘হলুদ নদী সবুজ মন’ ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ‘শহরতলী’ ‘প্রাণেশ্বরের উপাখ্যান' ইত্যাদির যেন কোনও তুলনাই হয় না ।
৩রা ডিসেম্বর, ১৯৫৬, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটে।
No comments: