তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর কিছু বাণী
⚫ ‘যে বই লেখক লিখতে চান' যাতে তার মনের শেষ কথা বা শ্রেষ্ঠ উপলব্ধির কথাটি বলা হয়ে যায় সেই বই কখনও লেখা হয় না—অথবা যদিও লেখা হয় তবে তার লেখা সেই বইয়েই শেষ হয়ে যায়-লেখার কাজ ফুরিয়ে যায়। হয়তাে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই ‘যে বইটি লিখতে চাই’ সে বইটির পরিকল্পনা যে কি তাও সঠিক বা স্পষ্টভাবে আমাদের মনের মধ্যে রূপ নিয়ে ফুটে ওঠে না; মায়ের মনের ইচ্ছার মতােই ইচ্ছা হয়েই থেকে যায়। এক একজন মহান লেখক হয়তাে লিখে গেছেন। যেমন বাল্মীকি। রামায়ণ তিনি লিখতে চেয়েছিলেন অথবা লিখতে বসে যে বই তিনি লিখতে চেয়েছিলেন—রামায়ণেই তা লেখা হয়ে গেছে—তাই রামায়ণ ছাড়া দ্বিতীয় গ্রন্থ তিনি লেখেন নি।
⚫ মানুষ যখন মনুষ্যত্বকে বুকের মধ্যে পায় তখন সে মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে মানুষের জাতি নাই, ধর্ম নাই, তখন সে কারও অপেক্ষা ছােট নয়, শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারও তার মধ্যে থাকে না।
⚫ এখানে (পল্লী গ্রামে) মানুষ অশিক্ষিত, অথচ শিক্ষার প্রভাবশূন্য অমানুষ নয়। অশিক্ষার দৈন্যে ইহারা সঙ্কুচিত, কুশিক্ষা বা অশিক্ষার ব্যর্থতার দম্ভে দাম্ভিক নয়। শিক্ষা এখানকার লােকের না থাক, একটা প্রাচীন জীর্ণ সংস্কৃতি আজও আছে—অবশ্য মুমুর্মুর মতােই কোনাে মতে টিকিয়া আছে। কিন্তু তাহারও একটা আন্তরিকতা আছে।
⚫ হিংসা কোথায়? হিংসা আঘাতের দুঃখে। আঘাত কোথায় ? আঘাত বঞ্চনায়—আঘাত বঞ্চনায়—আঘাত অপমানে, আঘাত অভাব পীড়নে। বঞ্চনা অপমান অভাব কোথায় বৈষম্যে। বৈষম্য কোথায় ? বৈষম্যের মূল। আশ্রয় বস্তুগত সম্পদে। বস্তুগত সম্পদের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ ভূমি। তারপর অন্য সব। সেই কারণেই সমাজতন্ত্রের প্রথম পন্থা ভূমি জাতীয়করণ। রক্তাক্ত বিপ্লবের পথে, আইনের দ্বারা। কিন্তু হিংসা প্রশ্রয় পায়। এমন কি আইনের দ্বারা জাতীয়করণের মধ্যে পরােক্ষভাবে শক্তির প্রয়ােগ আছে। সুতরাং প্রেমের পথে হোক জাতীয়করণ । স্বেচ্ছায় অধিকার বর্জনের পথে , ত্যাগের পথে । আলো বাতাস, জল , ভূমিতে সবার সমান অধিকার । পৃথিবী সবার, সুতরাং ভূমি সকলজনের।
⚫ যে যাত্রা করিয়াছে, সে-ই পরমকে পাইয়াছে, যে মধ্যপথে থামিয়াছে, সে পায় নাই, কিন্তু চলা যাহার থামে নাই, সে কবে বঞ্চিত হইয়াছে।
⚫ এক বয়সে মানুষ পুতুল নিয়ে খেলা করে, পুতুল খেলার বয়স গেলে ভগবান দেন রক্তমাংসের পুতুল মানুষকে খেলবার জন্য।
⚫ এ সংসারে মানুষকে কঠোর সমালােচক বলিলে তাহার অতি প্রশংসা করা হয়—মানুষ নিন্দুক, পরনিন্দার উপর তাহার একটি সহজাত লিপ্সা আছে, সাদার গায়ে কালি ছিটাইয়া তাহার পরম তৃপ্তি।
⚫ মানুষের মনের চেয়ে বড় শত্রু বােধ করি মানুষের আর নাই।
⚫ মানুষ নাকি চিরদিন ছেলেমানুষ। খেলার শখ, কৌতুকের প্রলােভন কোনাে দিনই তাহার যায় না।
⚫ মানুষের সাহিত্য প্রধানত মানব-জীবনাশ্রয়ী। মানুষের জীবন সংঘর্ষের মধ্যে চলমান-গতিশীল। ফুলের মতাে পাখির মতাে তার জীবনগতি রূপ, রস ও সঙ্গীতে প্রকাশিত হয়েই গতিহীন হয়ে যায়নি। এমন কি যে মানুষ পৃথিবী এবং সূর্যের ওপর নির্ভরশীল, সেই মানুষের জীবনের গতি ও অগ্রগমন—চন্দ্র-সূর্য-পৃথিবী অপেক্ষাও বেগবান এবং বিচিত্র। পৃথিবী এবং সূর্যের কামনা নেই, বাসনা নেই, চিন্তা নেই, অভিপ্রায় নেই, প্রচণ্ড এক অনবসর ঘূর্ণমানতার গতির নিয়মের বাইরে অবকাশও নেই। তাদের বাক্য নেই, তাদের আত্মবিশ্লেষণ নেই, তারা নিজেকে আমি বলে চেনে । মানুষের আছে, মানুষ নিজেকে বিশ্লেষণ করে চলেছে, নিজেকে আমি বলে ব্যক্ত করে চলেছে, তার বাক্য আছে। এই আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মপরিচয়ের সাধনাই তার প্রাণধর্ম, সকল যুগেই সে সভ্যতা ও সাধনার অগ্রগামিনী ধারা। তাই সাহিত্যে একমাত্র উৎস সাহিত্যিকের স্বীয় বিবেক ও উপলব্ধি।
⚫ চাষ আর বাস’ পল্লীর জীবনে দুইটা মাঠ। মাঠ আর ঘর—এই দুইটি ক্ষেত্রেই এখানে জীবনের সকল আয়ােজন—সকল সাধনা।
No comments: