অম্লান দত্তের বানী
*সুন্দরকে রক্ষা করবার জন্যও নিতান্ত সৌন্দর্যপ্রিয়তাকে অতিক্রম করেতে হয়। এখানে ভােগটা প্রধান কথা নয়, পুজোটাই প্রধান। এ যেন আরতির ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেবীর মুখ দর্শনের মতাে।
* সন্তানকে জননী ভালােবাসেন বলেই সন্তান পালনের ক্লেশও রমণীয়। এখানে সুখ-অসুখের হিসাবটা আগে নয়, ভালােবাসাটাই আগে। এই অযৌক্তিক ভালােবাসার প্রভাবেই সাধারণ দৃষ্টিতে যা ক্লেশ তা সুখদায়ক হয়ে ওঠে।
* বিনয় যদি বিদ্যার ভূষণ হয় তবে তার মূলে সত্যের প্রতি একটা সদাগ্রহ থাকে। বিজ্ঞানের সত্য সর্বক্ষণই নতুন তথ্য ও যুক্তির আলােতে নিজেকে সংশােধন করতে আগ্রহী। এই সত্যাগ্রহই বিদ্যার ক্ষেত্রে বিনয়ের রূপে দেখা দেয়।
* মানুষের চেতনার মৃত্তিকাকে মৃত্যু নিয়ত উর্বরা করে চলেছে। মৃত্যু করুণার উৎস। আবার মৃত্যুই পারে মানুষকে দিতে মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস। এই করুণা ও ভয়হীনতার মিশ্র উপাদানে সৃষ্টি হয় মানুষের মহত্ত্ব।
* মানুষের সঙ্গে মানুষের তিন প্রকার সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। প্রথমটির নাম দেওয়া যেতে পারে আত্মীয় সম্পর্ক, দ্বিতীয় ব্যবহারিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক, তৃতীয় আগ্রাসী সম্পর্ক।
* যন্ত্র পাবার ইচ্ছেটাকেই প্রবল করে তােলে, দিতে শেখায় না। যন্ত্র মানুষকে করে তােলে ভােগবাদী, ত্যাগী করে না। যদিও যন্ত্র মানুষেরই সৃষ্টি তবু যান্ত্রিকতার গুণে অধিকাংশ মানুষ স্রষ্টার ভূমিকা থেকে নির্বাসিত।
* মৃত্যুর একটি দৈবীশক্তি আছে। সে সংসার থেকে উত্থিত হয়েও সংসারের সঙ্গে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করে দাঁড়ায় যে, আমরা তখন ক্ষুদ্র কলহ স্বার্থবুদ্ধির তুচ্ছতা থেকৈ মুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে যেন একটি চিরন্তন রূপে দেখতে পাই।
* মৃত্যু সামান্য জীবনের দুয়ার ভেঙ্গে আমাদের এক জ্যোতির্ময়তার প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
* এই যে আমরা সত্যের আলােককে হৃদয়ে গ্রহণ করতে পারছি না, এ জন্য একটা অভাববােধ অন্তরে জাগিয়ে রাখা দরকার।
* জীবনের এই চলমান গাড়িটি স্টেশনে কিছু যাত্রীকে নামিয়ে দেয়, কিছু যাত্রী তুলে নেয়। যদি কাউকেই নামানাে না যেত তবে কয়েক স্টেশন পরেই গাড়ির ভিতর ভিড়ের চাপ এমন অসহ্য হত যে নতুন যাত্রীকে তােলা একেবারে অসম্ভব হত। মৃত্যুর অবিরাম ধারাই নবজন্মের জন্য অবিরত স্থান সৃষ্টি করে দেয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মৃত্যু যদিও আমাদের দুঃখে কাতর করে তবু এই মহাবিশ্বের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে যখন আমরা তাকাই, তখন দেখি যে, বহু দুর্যোগের ভিতর দিয়ে মহামরণের সযত্ন হস্ত মহাজীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
* শিক্ষা ও রাজনীতির প্রকৃতি ভিন্ন। দলীয় রাজনীতির প্রয়ােজন শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শিক্ষার চরিত্র নষ্ট হয়।
* অবিভাজ্য সংস্কৃতি অহমিকার পতাকা তুলে হিংসা এবং অসহিষ্ণুতার আঘাতে সংস্কৃতিকে খণ্ড খণ্ড করাটা শােচনীয় হঠকারিতা।
* নিয়মই ন্যায়ের ভিত্তি। শুধু প্রেমের ওপর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, কারণ প্রেম চঞ্চল, প্রেম নিরপেক্ষ নয়, প্রেম বিচারে অপটু।
* ধর্মরােষ অথবা আদর্শবাদী উৎসাহের আতিশয্য নিয়ে সুস্থ সমাজ চলকরে, যুক্তিবিচারের সাহায্যে, এটাই সমাজজীবনের পক্ষে অধিক নিরাপদ। বিচার-বিবেচনা করে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষ মানুষের সঙ্গে সহযােগিতার সম্পর্কে আবদ্ধ হবে, এতেই সকলের মঙ্গল।
* ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে নয়; বরং স্বার্থকে আশ্রয় করে যে সহযােগিতা, মানুষের দৈনন্দিন প্রয়ােজনের কঠিন মাটিতে যার মূল, সেই সহযােগিতাই নির্ভরযােগ্য।
* সাম্প্রদায়িক চেতনায় বাস্তবে বিকৃত প্রতিফলনই দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ।
* প্রতিটি গ্রামের কয়েক মাইলের ভিতর একটি করে মহানগরী বসানাে যায় , কিন্তু ছােটো শহর এনে দেওয়া যায়। ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশে আছে গােটা পনেরাে গ্রামের জন্য একটি ছােট শহর। ...আমাদের দেশে শহর পিছু গ্রামের সংখ্যা দুশাে, কোথাও কোথাও আরও অনেক বেশি।
শহর ও গঞ্জ জাগিয়ে তােলার জন্য পরিকল্পনা চাই। এটাও উন্নয়নের ভিত তৈরি করার কাজের অঙ্গ। কোনাে একটি অঞ্চলের এত মাইল রাস্তা হবে বলাটাই যথেষ্ট নয়। গ্রাম এবং বর্তমান ও সম্ভাব্য ছােটো শহর নিয়েই আমরা সেই বিন্দুগুলাে পাই, যাদের ভিতর রেখা টেনে টেনে পথ-ঘাটের একটা রূপরেখা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর এ কথাটা শুধু পথঘাট সম্বন্ধে প্রযােজ্য নয়। শিক্ষা, বিদ্যুৎ সব কিছু পরিকল্পনার জন্যই এইরকম কয়েকটি স্থির বিন্দুর প্রয়ােজন হয়। গ্রাম এবং নতুন উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়েই রচনা করা যায় আঞ্চলিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আধার। মানুষের ভালােবাসা ও সেবার ব্যাকুলতা স্বাভাবিক নির্গমনে ব্যর্থ হলে ভ্রান্ত পথে চলে যেতে চায় আর তখন তাদের মূর্তি হয়ে ওঠে সংহারক।
* সুখ-অসুখের হিসাব মিলিয়ে যিনি জীবনযাপন করতে চাইবেন জীবন ধারণ তার কাছে শীঘ্রই একটা বিড়ম্বনা স্বরূপ দেখা দেবে।
No comments: