অমৃতসরের ইতিহাস
পর্যটকদের কাছে পাঞ্জাবের প্রধান আকর্ষণ অমৃতসর। পাকিস্তান সীমান্ত (ওয়াঘা) থেকে মাত্র ১৬ মাইল (২৯ কিমি) দূরে এই শহর। পাঞ্জাব সংস্কৃতি ধর্মের প্রাণকেন্দ্র। রাজধানী চন্ডিগড় হলেও স্বাধীনােত্তর কাল থেকেই পাঞ্জাবের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শহর এই অমৃতসর। একসময় কাবুল, কাশ্মীর ও তিব্বত থেকে ভারতে বাণিজ্যের প্রবেশপথ ছিল এই শহর। চন্ডিগড়ের পরেই পাঞ্জাবের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরের জনসংখ্যা প্রায় চার লক্ষ। বিশ্বের সমস্ত শিখ সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্রতম শহর। এর উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে জনশ্রুতি। গুরু নানক শিষ্যদের নিয়ে চলেছেন দেশভ্রমণে। চলতে চলতে এক নির্জন প্রান্তরে এসে পড়লেন। দীর্ঘ পথশ্রমে তৃষ্ণার্ত সকলে। নানক এক শিষ্যকে বললেন জলের সন্ধান করতে। শিষ্য কিছু দূরে গিয়ে দেখলেন কাছেই পুকুর কিন্তু এক ফোঁটা জল নেই তাতে। শিষ্য ফিরে এসে নানককে বলতেই তিনি বললেন এবার যাও জল পাবে। পুকুরে গিয়ে শিষ্য অবাক। জলে ভরে গিয়েছে পুকুর। কি অপূর্ব স্বাদ তার জলের, ঠিক যেন অমৃত। সকলে নাম দিলাে অমৃত সায়র (সায়র অর্থ পুকুর)। ৪র্থ শিখ গুরু রামদাস এখানে মন্দির গড়ে তােলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট আকবর (১৫৭৭) দিঘি আর জমির অধিকার দান করেন রামদাসকে। রামদাসের শিষ্য, ৫ম গুরু অর্জুন সিং এই সরােবর সংস্কার করে তার মাঝে গড়ে তােলেন হর মন্দির। অমৃত সায়রের নামে অঞ্চলের নাম হয় অমৃতসর। সেসময় গুরু অজুন সিংহ রচনা করেন গুরু গ্রন্থ সাহিব। এই অমৃতসরকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় শিখ ধর্মের নবজাগরণ। মােগল শক্তি বারংবার আঘাত হেনেছে। অমৃতসর দখল করে ধ্বংস করেছে মন্দির। আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে মন্দির। আজকের সুবিশাল হর মন্দির গড়ে তােলেন পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিং (১৮৩০)। সােনার পাতে মুড়ে দেন মন্দিরের গম্বুজ। সেই থেকে এর নাম হয় স্বর্ণ মন্দির, অনেকে বলেন দরবারা সাহিব। অমৃতসরের প্রধান আকর্ষণ স্বর্ণমন্দির। বিশাল প্রাঙ্গণ জুড়ে মন্দির, এর বিশালত্ব বৈভব দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। মন্দিরের দেওয়ালে নানান কারুকার্য। সরােবরের চারদিকে মার্বেল পাথরের প্রদক্ষিণ পথ, প্রবেশ পথ চারটি। অলঙ্কৃত রুপাের দরজা। মন্দিরের অভ্যন্তরে রয়েছে সােনা-রুপাে, হাতির দাঁতের কাজ। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে আকাল তখত-এ রয়েছে। শিখ গুরুদের ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, মণিমুক্তা। মণিমাণিক্যখচিত চন্দ্ৰতপ বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। সরােবরের পশ্চিম তীর থেকে সরু পথ জলের উপর দিয়ে গিয়েছে মূল মন্দিরে। তিনতলা মন্দিরের দরবারা সাহেবে রয়েছে শিখ ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ শ্রীগুরু গ্রন্থসাহিব। এখানে কোনও দেবতা নেই, নেই কোনও পূজা পাঠের অনুষ্ঠান। গুরু গােবিন্দর সংকলিত হাতে লেখা গ্রন্থসাহিবকে এখানে পবিত্র জ্ঞানে শ্রদ্ধা জানানাে হচ্ছে। দিবারাত্র চলেছে পাঠ। দিনের বেলায় সর্বসাধারণের প্রদর্শনের জন্য স্বর্ণমন্দিরে রাখা হয় গ্রন্থসাহিব, রাতের স্বর্ণখচিত রুপাের পালকিতে শােভাযাত্রা করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আকাল তখতে। পরদিন আবার একইভাবে নিয়ে আসা হয় স্বর্ণমন্দিরে। স্বর্ণমন্দিরের অদূরে সরােবরের ধারে পাঁচতলা আকাল তখত। যার অর্থ দেবতার সিংহাসন ভবন। এখান থেকেই শিখ ধর্মের যাবতীয় নিয়ম নীতি নির্ধারণ হয়। শিরােমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির যাবতীয় কার্য পরিচালনা হয় আকাল তখত থেকে। ১৯৮৪-এ এই আকাল তখতেই গড়ে উঠেছিল সন্ত জারনেল সিং ভিনদ্রানওয়ালার নেতৃত্বে উগ্রপন্থীদের ঘাঁটি। ভারতীয় ফৌজ এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে মুক্ত করে আকাল তখত। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংস্কার করে আবার নতুন করে গড়ে উঠেছে তখত। তখতের বিপরীতে রয়েছে লঙ্গরখানা। জাতিধর্ম নির্বিশেষে বিশাল হলঘরে হাজারের বেশি মানুষ একসাথে বসে খান। সারাদিন ধরে চলে এই খাবার। বিশাল আয়ােজন। দর্শনার্থীরাই যে যেমন পারছে 'আটা মাখছে, বাসন পরিষ্কার করছে, ঝাট দিচ্ছে। মন্দিরের এক প্রান্তে বাগিচার মধ্যে ৯ তলা বাবা অটলের স্মৃতিসৌধ। গুরু হরগােবিন্দের পুত্র অটল ছিলেন অলৌলিক শক্তির অধিকারী। একবার তিনি এক মৃত ব্যক্তির জীবন দান করেন। লৌকিক জীবনে অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশে ক্ষুব্ধ হন হরগােবিন্দ। অনুতাপে আত্মহত্যা করেন বাবা অটল। তারই স্মৃতিতে গড়ে উঠে এই সৌধ। এখান থেকে দেখা যায় অমৃতসর শহর।
No comments: