আমিএকজনশিক্ষক ।ঘরে বসে দুমাস ধরে যে সরকারের কাছ থেকে বেতন নিচ্ছি।এই বিষয়ে কথা বলার আগে একটা ঘটনা শেয়ার করি আপনাদের সঙ্গে।
একবার হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে ফেরার সময় বাধ্য হয়ে জেনারেল কামরায় উঠি।ওঠা থেকেই পিছনের দিকে কোনা থেকে কিছু অল্পবয়সী ছেলেদের উল্লাসময় চিৎকার এবং নিজেদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ইয়ার্কি ঠাট্টায় সবাই বিরক্ত হই। কিছুক্ষন পর ফিরে তাকাতেই তাদের একজনের দিকে চোখ পড়ে এবং চিনতে পারি সে আমারই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। সেও চিনতে পারে এবং হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে কেমন আছি।আমি আবার আমার মত থাকি।খানিক পর খেয়াল করি পুরো গ্রূপটাই চুপচাপ। অল্প কিছু কথা ভেসে আসছে তবে বেশ নিচু গলায়।তারকেশ্বর অবধি এটাই চলে।বুঝতে পারি ছাত্রটি বাকিদের নিয়ন্ত্রণ করেছে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন বশত।
এটা একটিমাত্র নয়।এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা শিক্ষকরা সকলেই কমবেশি।আর যারা শিক্ষক নন তারাও।শিক্ষকদের সুকর্মের সুফলটা কিন্তু সকলেই ভোগ করেন।নিশ্চিন্ত সুষ্ঠ সামাজিক জীবন যাপন করেন।
এবার বলি কেন এই ঘটনার অবতরণ।
আপনারা যারা বলছেন আমরা বিনা শ্রমে বেতন নিচ্ছি তারা একটিবারও ভেবে দেখেছেন 'শিক্ষা' কি?ঘন্টা ধরে সময় মেপে পাঠ্যপুস্তক আউড়ে দেয়াটাই কি শিক্ষা? না।সেটা আপনারাও জানেন। কিন্তু স্মৃতি বিচ্যুতির কারনে আজ রে রে করে উঠছেন শিক্ষকের বিরুদ্ধে।ভেবে দেখেছেন আপনার ছাত্রাবস্থায় আপনি শিক্ষককে কি দিয়ে বিচার করতেন?তাদের মাসমাইনে কত খোঁজ রাখতেন? না।বরং বলব তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ অভ্যাসগুলো খুঁটিয়ে দেখতেন।তাদের অনুকরণ অনুসরণ করবার কথা ভাবতেন।ভালোবাসে দুষ্টুমি করে তাদের নানান নামকরণ করতেন।তাদের দেওয়া শিক্ষা কাজে লাগিয়েই আজ আপনারা সমাজে সভ্য বলে পরিচিত।যেমন করে ওই ছেলেগুলি সেদিন তার অর্জিত শিক্ষার পরিচয় দিয়েছিল। অর্থাৎ ভাঙিয়ে খাওয়া। শিক্ষকের কাছে থেকে আমরা যা পাই তা আসলে সময়ের মাপদন্ড দিয়ে বিচারযোগ্য নয়। ক্লাস শেষ হয়ে যায় ।স্কুল ছাড়তে হয়।কিন্তু শিক্ষাটা বহন করে নিয়ে যায় ছাত্ররা।ভবিষ্যৎ জীবনে একজন সুনাগরিক হয়ে ওঠে।
তাই আজ যে ছেলেটা রাস্তায় থুথু ফেলছেনা,জল অপচয় করতে গিয়ে একবার থমকাচ্ছে,পরিবেশ নিয়ে ভাবছে,মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়াচ্ছে,কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছি আমরা। কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো শিক্ষক রয়েছেন একজন ভালো নাগরিক গঠনে। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব অনুসরণ করতে চাওয়া ছাত্রাবস্থায় খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা যা আপনিও চেয়েছেন।কিন্তু আজ ভুলে গিয়ে বেতন নেওয়াটা দেখছেন।অলক্ষ্যে আমাদের শিক্ষার প্রবাহই যে আপনার সন্তানকে সুসন্তান করে রেখেছে,আপনার প্রতিবেশীকে সুপ্রতিবেশী করে রেখেছে আপনাকে প্রতিবাদমুখর সচেতন করে রেখেছে সেটা দেখতে পাচ্ছেননা।
#সিলেবাস শেষ হবেই।স্কুলও খুলবেই। কিন্তু বই পড়ে কি শিক্ষা সম্পুর্ন হয়?হয়না। হয় শিক্ষকের সান্নিধ্য থেকে। একটা সান্নিধ্য হাজারটা সুশিক্ষার বাহক।
গাছের মূল কোনোদিনই দেখা যায়না। পিতামাতা আর শিক্ষক এই ত্রয়ী আসলে শিকড়ের মত আড়ালে থাকে।কিন্তু এদের পুষ্টি সরবরাহ কখনো বন্ধ থাকতে পারেনা।এ নিরন্তর প্রবাহ। ছাত্রের অন্তরে প্রবাহিত হতে থাকে ।আর সমাজে তার ছাপ পড়তে থাকে।
আমি নিজে সেই কবে ছাত্রাবস্থায় আমার শিক্ষকদের বেতন দিয়েছি ।বিনিময়ে ক্লাস নিয়েছি। কিন্তু ক্লাসের বাইরে তাদের থেকে যা নিয়েছি সেই তাদের শিক্ষাকে ভাঙিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বকে অনুসরণ করেই আজও আমার শিক্ষকজীবনকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছি।মেপে তো দেখিনি কতটা দিয়েছি আর কতটা পেয়েছি।
মালির মত গোড়ায় সার জল দিয়ে যে শক্তি সঞ্চয় করে দেন শিক্ষকরা তাই আজীবনের পুঁজি হয় ছাত্রদের। কিছুদিন পর তার প্রয়োজন ফুরোয় ঠিকই কিন্তু তার অবদান ফুরোয়না।
তাই কতটা দিলাম কতক্ষন দিলাম না দেখে সিলেবাসের বাইরে বেরিয়ে ভাবুন কি দিলাম আমরা। আর একটিবার আপনার ছাত্রাবস্থায় ফিরে যান।দেখবেন শিক্ষক আসলে শিক্ষা থেকে বিরত থাকেননি কখনো। প্রতিটা ক্ষেত্রে সফল মানুষের পিছনে একজন না একজন শিক্ষক অবধারিতভাবে আছেন। একবার নির্মল হোন। হিংসামুক্ত হোন আপনার জীবনের সেই সব শিক্ষকদের সম্মানার্থে।
স্কুল মানে একটা বিল্ডিং শুধু নয়। একটা সম্পর্ক।এ অবিচ্ছেদ্য। দুমাস তিনমাস বিরতি থাকতে পারে ঘন্টা বেঁধে ক্লাসরুমে।কিন্তু ঘন্টার বাইরে ক্লাসের বাইরে জানবেন ক্লাস সবসময় চলছে। আর যেটাকে আপনারা বেতন বলছেন সেটা আসলে আমরা জানি সাম্মানিক হিসাবে।যারা কথায় কথায় চাণক্য আওড়ান তারা ভুলে গেছেন তার অমোঘ বাণী।'একটি অক্ষর ও যদি শিক্ষক ছাত্রকে দেন তা কোনো পার্থিব বস্তু দিয়ে পরিশোধযোগ্য নয়'।
শুধু শিক্ষক হিসেবে নিজের কৈফিয়ত দিতে নয় যে লেখা লিখতে বাধ্য হলাম আমার জীবনে যাদের অবদান সেই সকল শিক্ষকদের সম্মান জানাতে। আর সেই সব ছাত্রদের ভালোবাসা জানাতে যারা আমাদের মাথা উঁচু করে দেয় গর্বে।যাদের জন্য চিৎকার করে বিনা দ্বিধায় বলতে পারি আমি একজন শিক্ষক। বলতে পারি ক্লাস চলছে।
- লেখাটি সংগৃহীত
লকডাউনে ঘরে বসে বেতন নিচ্ছেন শিক্ষক - ক্লাস কি চলছে ?
Reviewed by Wisdom Apps
on
June 14, 2020
Rating:
No comments: