'আনন্দ ও বেদনা--- উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সুর তরঙ্গায়িত '
পুরো নাম লুডউইগ ভন বিটোভেন। অত বড় সুরস্রস্টা মানব ইতিহাসে আর কেউ জন্মেছেন কিনা সন্দেহ। আনন্দ ও বেদনা-- উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর সুর তরঙ্গায়িত।
বিটোভেনর জন্ম জার্মানির রাসল্যান্ডে ১৭৭০ খৃষ্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বর। সঙ্গীতচর্চার পরিবার। বাবা জোহান বিটোভেন ভালো বেহালা বাজাতেন। তাঁর কাছেই বিটোভেনর বেহালার হাতেখড়ি। একটা ছোট ঘরে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেহালা ও পিয়ানো বাজাতেন। বাবার চারিত্রিক দোষ ছিল। খুব মদ খেতেন। তবে ছেলের ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল, বিটোভেন একজন বড় সঙ্গীতজ্ঞ হবেন। নয় বছর বয়সে অর্গানে তালিম নিতে শুরু করলেন রাজসভার অর্গানবাদক ক্রিশ্চিয়ান গোৎলভ নেফির কাছে।
মাত্র এগারো বছর বয়সে বিটোভেন রচনা করলেন পিয়ানোর সোনাটো---যা বিস্ময়কর।
১৭৮২ খৃষ্টাব্দে মাত্র বারো বছর বয়সে তিন মেয়রের সভায় সহকারী অর্গানবাদকের পদ পেলেন।
সব সময় সুরের সন্ধান করতেন। অসাধারণ ধৈর্য ও অধ্যবসায়। সঙ্গীতের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা তাঁর ধর্ম।
১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে মেয়র বিটোভেনকে ভিয়েনায় পাঠালেন মোৎজার্টের কাছে সঙ্গীতের উন্নততর পাঠ নেবার জন্য। কিন্তু মায়ের আকস্মিক মৃত্যুহেতু ফিরে আসতে হয় বিটোভেনকে।
বয়সে প্রায় কিশোর। কিন্তু সৃষ্টিতে যেন মধ্যবয়স্ক। বিভিন্ন আসরে পিয়ানো, ভায়োলিন বাজিয়ে শ্রোতাদের হৃদয় জয় করেছেন। এই সময়ই তাঁর সঙ্গে পরিচয় সুখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হেডেনের সঙ্গে।
বিটোভেনের তৈরি সুর শুনে হেডেন আকৃষ্ট হলেন। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে শেখালেন কয়েকটি সুর।
পরে কিন্তু দুই প্রতিভার মধ্যে টক্কর লাগে, যেহেতু বিটোভেনের প্রতিভা হেডেনের তুলনায় বেশী গভীর ছিল।
ভিয়েনার অভিজাত মহলে বিটোভেনের কদর দিন কে দিন বাড়তে থাকে। কিন্তু ব্যাক্তি বিটোভেনের মেজাজ প্রায়ই তিরিক্ষ হয়ে উঠত। কোনও কারণে মেজাজ হারালে তিনি কুৎসিৎ ভাষা প্রয়োগ করতেন।
সেই লোকই পিয়ানোর সামনে বসলে একেবারে অন্য মানুষ। যেন এক ঋষির সুরতপস্যা চলেছে। এক এক সময় সারা রাত ধরে বেহালা অথবা পিয়ানো বাজান। বহু নারী তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁরা সকলেই আভিজাত পরিবারের। কিন্তু কোনও সম্পর্কই টেকসই হয়নি। এইভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর বিটোভেন লক্ষ্য করলেন, তিনি ধীরে ধীরে বধির হয়ে যাচ্ছেন। ই অসুখ বংশানুক্রমিক। চিকিৎসায় ভালো হবার নয়। মর্মান্তিক হতাশায় বিটোভেনের আচরণ আরও রুক্ষ হয়ে ওঠে। এই দুঃখের সময়ে তাঁর কিশোরী ছাত্রী গিউলিয়েত্তা গুইসিয়ারদির মধুর সঙ্গ ছিল বিটোভেনের কাছে প্রেরণার একমাত্র উৎস। কিন্তু বিশেষ অভিজাত পরিবারের এই কুমারীর সঙ্গে বিটোভেনের স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন করাটা ছিল অবাস্তব ও অসম্ভব।
ভিয়েনা ছেড়ে বিটোভেন চলে যান হেলিজেনস্তেতে। ওই গ্রামাঞ্চলে তিনি চার বছর ধরে নিভৃতে সঙ্গীত চর্চা করেছেন। সৃষ্টি করেছেন একটার পর একটা সম্ফনি। ভায়োলিন সোনাটা, দ্য স্ট্রং কোয়ার্টেট, পিয়ানো ফোর্ট সোনাটা, পিয়ানো কনসার্টো--- তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি নতুন ও অনন্য। প্রতিটির সৌন্দর্য ও গভীরতা শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করে রাখতে সমর্থ।
বিটোভেনের অভিজাত ধনী বন্ধুরা তাঁকে আবার ভিয়েনায় নিয়ে এলেন। তাঁকে বাৎসরিক ৪০০০ ফ্লোরিন বৃত্তি দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
এই সময় জার্মানির শ্রেষ্ঠ কবি গ্যেটের প্রেমিকা বেটিনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বিটোভেন। কিন্তু এখানেও সপরিণতি সম্ভব ছিল না, যেহেতু গ্যেটে স্বয়ং ছিলেন বিটোভেনের গুণগ্রাহী বন্ধু।
১৮১৫ খৃষ্টাব্দে বিটোভেনের ছোট ভাই কার্ল মারা যান। কার্লের মৃত্যু বিটোভেনকে খুব আঘাত দেয়। তিনি কার্লের ন'বছরের ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু ওই ছেলেটাই পরবর্তীকালে দুর্বিনীত, মদ্যপ ও চরিত্রহীনে পরিণত হয়। এটা বিটোভেনের জীবনে আর একটা বড়ো ব্যার্থতা।
১৮৭২ খৃষ্টাব্দে ২৬শে মার্চ, এক বর্ষণমুখর দিনে বিষণ্ণ চিত্ত বিটোভেন শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিন
বিস্ময়কর বিটোভেন -এর আশ্চর্য জীবনী
Reviewed by Wisdom Apps
on
January 12, 2020
Rating:
No comments: