ভারত বাংলাদেশের হিলি বর্ডার কেমন ? এখানে কীভাবে যাবেন ? কীভাবে পার হবেন ? কি কি বিষয় খেয়াল রাখবেন ?
কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী ও শ্বাশুড়ি মা - বাংলাদেশের এক আত্মীয় ঘুরতে যাবেন ঠিক করলেন । তাদের পাসপোর্ট করাই ছিল । ১ মাসের ভিসা বের করে নেওয়া হল । হিলি বর্ডার দিয়ে পার করলে ওদেশে আত্মীয় বাড়ি বেশ কাছে হয় ,তাই ঠিক হল হিলি বর্ডারে গিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা হবে । আমার দায়িত্ব পড়েছিল বর্ডারে পৌছে দেওয়ার । নৈহাটি স্টেশন থেকে রাত ১১টা০৩ এ গৌড় লিঙ্ক এক্সপ্রেস ধরে বালুঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম । পরের দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বালুরঘাট স্টেশনে পৌছালাম ।
এই হল বালুরঘাট স্টেশন ।
শান্ত , নির্জন স্টেশন । দোকানপাট তেমন কিছুই নেই ।
স্টেশনের মেইন গেট দিয়ে বেরোলে দেখতে পাবেন টুকটুকি , অটো আর বাসের ভিড় । টুকটুকি রিজার্ভ করলে ৩০০ টাকা লাগে , রাস্তা খারাপ হওয়ায় টুকটুকি করে হিলি বর্ডার যেতে অনেক সময় লাগে , তাই আমরা বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । বাসে ভাড়া জনপ্রতি ২৮ টাকা । প্রায় ১ ঘন্টা বাস জার্নি করে হিলি বাস স্ট্যান্ডে পৌছালাম । বাস থেকে নামলেই টুকটুকি চালকেরা হাত ধরে টানাটানি করে । আপনি উঠতে না চাইলেও তারা আপনাকে টেনেই যাবে । ভাড়া মাত্র ১০ টাকা । আসলে বাস স্ট্যান্ড থেকে ঠিক ২ মিনিট হাটলেই হিলি বর্ডারে পৌঁছে যাবেন ।টুক্টুকির কোনো দরকার পড়ে না । তবে সাথে বেশী লাগেজ থাকলে টুকটুকি করে নেওয়া ভালো ।
বর্ডারের কাছে পৌছানোর ঠিক আগে রাস্তার বা হাতে একটি ভালো হোটেল দেখতে পাবেন , পূজা হোটেল । খিদে পেলে এখানে খাওয়া দাওয়া সেরে নিতে পারবেন ।
হোটেল থেকে একটু এগিয়ে গেলেই বর্ডার ।
বর্ডারে প্রথমেই পাবেন , ইমিগ্রেশান চেক পোষ্ট ।
এই অফিসের সামনে এলেই কয়েকজন মানুষ আপনার কাছে এসে জিজ্ঞেস করবে - " আপনি কার লোক ? " , এর অর্থ - আপনার পাসপোর্টেটি নিয়ে কে কাজ করে ? চেনা কেউ থাকলে তাঁর নাম করলেই আপনাকে ছেড়ে দেবে । নতুন হলে অনেকেই আপনাকে " তাঁর লোক " করার চেষ্টা করবেন । ভদ্র সভ্য লোক দেখে বিশ্বাস করে তাঁর হাতে আপনার পাসপোর্টটি দিয়ে দিতে হবে । বাংলাদেশে কোথায় কার কাছে যাবেন তাঁর ঠিকানা , ফোন নাম্বার এবং আপনার বিস্তারিত ঠিকানা ও ফোন নাম্বার শুনে নিয়ে সেই ভদ্রলোক সমস্ত ফর্ম ফিলাপ করে লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিয়ে দেবেন । সিরিয়ালে আপনার নাম এলে তারাই আপনাকে ডাক দিয়ে ভিতরে গিয়ে ছবি তুলতে বলবে । সব হওয়ার পর আপনার হাতে পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার আগে এই কাজগুলি করার পারিশ্রমিক হিসাবে তাঁর প্রাপ্য টাকা তিনি চেয়ে নেবেন । আপনি চাইলে নিজে এই সমস্ত কাজ করতে পারেন তাহলে কোন এক অজানা কারনে আপনাকে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতে পারে , বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা । আমি মনে মনে ভাবলাম এনারা একটা সার্ভিস দিচ্ছেন তাই দালাল না বলে সার্ভিস প্রোভাইডার বলাই ভালো । ৫০ / ১০০ টাকা সার্ভিস চার্জ দেওয়া আর কি । প্রয়োজনে এনাদের কাছ থেকে টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিতে পারেন । অবশ্যই প্রতি ক্ষেত্রে দরদাম করে নেবেন , এক এক জনের কাছে এনারা এক এক রকম টাকা দাবি করেন । আমাদের সামনেই দেখলাম এক ভদ্রলোককে ভারতীয় ১০০ টাকার বদলে ১১৩ বাংলাদেশী টাকা দিলেন পাশে অন্যজনকে ১১৭টাকা দিলেন । কাজেই সাবধান হয়ে শান্ত মাথায় দরদাম করতে হবে । ফর্ম টম ফিলাপের পর কাস্টমস ক্লিয়ার করতে হবে ।
এটি হল কাস্টমস অফিস ।
এখানে চেকিং হওয়ার পর এগিয়ে গিয়ে একটা রেজিস্টার খাতায় সই করতে হবে । তারপর আপনার সিকিউরিটি চেক হবে । বিএসেফ রক্ষীরা আপনার ব্যাগের জাবতীয় জিনিসপত্র নেড়ে চেড়ে সিকিউরিটি চেকিং করবে । কাস্টমস থেকে সিকিউরিটি চেকিং পর্যন্ত ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি ছেলে প্রস্তুত থাকে , আপনি না চাইলেও সে আপনার ব্যাগ বয়ে নিয়ে পৌঁছে দেবে , এবং ১০/ ২০ টাকা চাইবে ।
পায়ে হেঁটে নো ম্যান্স ল্যান্ড পার করলে বাংলাদেশ সিকিউরিটি চেকাপ । বাংলাদেশের বর্ডার সিকিউরিটি ফোরস ঠিক একইভাবে নেড়ে চেড়ে ব্যাগ পরীক্ষা করে , পাসপোর্ট চেক করে আপনাকে বাংলাদেশ প্রবেশের অনুমতি দেবে । ওদেশে ঢুকে প্রথমে কাস্টমস ক্লিয়ার করতে হবে , তারপর ফর্ম ফিলাপ ও অন্যান্য নিয়ম পালন করার পর দেশে ঘোরার অনুমতি পাবেন ।
বড়ই আশ্চর্য লাগবে দেখলে । একটি রেলগেট , গেটের এপারে ভারতবর্ষ আর ওপারে বাংলাদেশ ।
প্রায় সবসময়ই দেখা যাবে কিছু মানুষ গেটের দুইপাশে দাড়িয়ে আছেন । একবাংলার মানুষ অপেক্ষা করছেন আরেক বাংলার মানুষের ।
এই রেলগেটটি কিন্তু সচল গেট । সঠিক সময়ে গেলে এই রেল লাইন দিয়ে বাংলাদেশের ট্রেন চলাচল দেখতে পাবেন ।
যাইহোক , আপনি যদি কাউকে পৌঁছে দিতে যান তবে অবশ্যই নিজের অরিজিনাল ভোটার / আধার কার্ড এবং সাথে একটি জেরক্স কপি সঙ্গে নিয়ে নেবেন । অনেক সময় বর্ডারে জিজ্ঞাসাবাদ করে । প্রয়োজনে পরিচয়পত্র দেখাতে হতে পারে ।
এই ছিল হিলি বর্ডার , রেলগেট পেরোলেই দেশ বদল ।
আর , প্রথমে বললাম যে একটি মজার ঘটনা বলব । সেটা শোনাই । বর্ডারে যাওয়ার দিন নো ম্যান্স ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের বাংলদেশের আত্মীয়দের সাথে ছবি তুলছিলাম । সেই সময় দেখি একটি ছেলেকে বি-এস-এফ রা ধরেছে । জানতে পারলাম ছেলেটি ব্যবসা করে । ভারত থেকে দার্জিলিং-চা কিনে নিয়ে বাংলাদেশে বিক্রি টিক্রি করে হয়ত । দুটো বড় বড় জারে করে চা পাতা নিয়ে যাচ্ছিল । সিকিউরিটি চেকাপের সময় বাংলাদেশের আর্মি চায়ের জারের সিল কেটে চা বের করে শুঁকতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন জারের ভিতর একটি বড় বোতল লোকানো । আমাদের সামনেই দেখলাম দুটি জার থেকে উদ্ধার হল দুটি বোতল । দুটি বোতলেই বিদেশী ব্র্যান্ডের নিষিদ্ধ পানীয় ভরা । আর যাবে কোথায় ?? কান ধরে নাক ধরে বারবার ক্ষমা চাইতে লাগলো ছেলেটি ।
ছেলেটি বয়স ২৭ / ২৮ হবে , গায়ে গোল গলা লাল গেঞ্জী , আর জিন্স প্যান্ট , মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি । ধরা পরেই সে কথা বলা শুরু করে দিল । তাঁর বক্তব্য হল - সে এই চা কিনেছে দোকান থেকে , কে যে এর মধ্যে বোতল ঢুকিয়েছে তাঁর জানা নেই । এই কথা শুনেই বি-এস-এফ থেকে সাধারন পাবলিক সবার হাসি পেয়ে গেছিল । ছেলেটি জেল খাটার ভয়ে নিজে নিজেই কান ধরে উঠবস করছিল । সে সব দৃশ্য ভিডিও করা সম্ভব হয়নি কিন্তু কল্পনা করে নিন , হাসবেন না কাঁদবেন । এইসব দেখে , ফেরত আসার সময় - পথে,পাকা রাস্তার ধারের একটা গ্রামে একটি কালী মন্দীর দেখেছিলাম । লোকাল লোকেদের কাছ থেকে জানতে পারি এটি ১০০০ বছরের পুরানো মন্দির । সেই মন্দির নিয়ে পরের পোস্টে লিখবো । কোনো কিছু জানতে চাইলে নীচে কমেন্ট করতে পারেন ।
ভালো থাকবেন , সুখে থাকবেন ।
" হিলি বর্ডার নিয়ে আমাদের একটি ইউটিউব ভিডিও আছে , দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন "
বালুরঘাট থেকে হিলি - ভারত বাংলাদেশ বর্ডার - ভ্রমণ ও পারাপার গাইড
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 08, 2019
Rating:
No comments: