"ওমা সকাল সকাল আবার প্রণাম কেন বাপু?"
নতুন বৌ স্নিগ্ধা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে গা ঢাকতে ঢাকতে বলে," আসলে মা আজ আমার জন্মদিন তো তাই। এটাই অভ্যেস হয়ে গেছে আমার,ও বাড়িতে থাকতে মা বাবাকে ঘুম থেকে উঠেই প্রণাম করতাম।"
একটু ছোট হাই তুলে ওর শাশুড়িমা ঊষা বলেছিলেন," তা ভালো থেকো,মানিয়ে গুছিয়ে সংসার কোরো। সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক,শত পুত্রের জননী হও।"
মায়ের আশীর্বাদ শুনে নতুন বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলো শুভময়। একটু হেসে মাথা নিচু করেছিলো ও।
..." তা শুভ বলেনি তোমাকে আমাদের বাড়িতে মেয়ে বৌদের জন্মদিন টিন হয়না। শুধু ঐ ছেলেদের জন্মদিনে একটু পায়েস মিষ্টি খাওয়াই ঐটুকুই।
সেদিনের একুশের স্নিগ্ধা তারপর এই বাড়িতে শাশুড়িমায়ের সাথে কাটিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো বছর। প্রতিবারই যদিও জন্মদিনের দিন একটা প্রণাম করে শাশুড়িকে কিন্তু প্রথম বছরেই জেনে গিয়েছিলো এ বাড়িতে মেয়ে বৌদের জন্মদিন পালন হয়না।
প্রথম দুএকটা বছর খুবই খারাপ লেগেছিলো কারণ বাপের বাড়িতে থাকতে মা বেশি কিছু না পারলেও একটু লুচি ছোলার ডাল আলুরদম আর পায়েস দিয়ে ওদের দুই ভাইবোনের জন্মদিনেই খাওয়াতো। কখনও বা হত পোলাও মাংসও,দুএকজন বন্ধুবান্ধবও আসত ওর আর দাদার।
স্নিগ্ধার বাপের বাড়ি দূরে তাই হুট করে সেখানে চলে যাওয়া যেতনা সংসার ফেলে। তখন এত ফোনেরও চল ছিলোনা। তাই চিঠিই ভরসা,বাবার চিঠিটা ঠিক এসে পৌঁছতো সেই দিন বা আগের দিন ,"স্নিগ্ধা মা জন্মদিনের অনেক আশীর্বাদ রইলো। খুব ভালো থাকিস আর সবাইকে ভালো রাখিস।"..কখনোও পাশে মায়ের লেখা দুচারটে শব্দও থাকতো। আবার যদি কখনও ঐ সময় ওখানে থাকতো তাহলে বাড়িটা লুচিভাজার গন্ধ আর মাংসের গন্ধে ম ম করতো। তার সাথে বাবার দেওয়া শাড়ি,দাদার দেওয়া উপহার।
অবশ্য এই বাড়িতে জন্মদিন পালন বারণ থাকলেও শুভময় প্রতিবারই হাতে করে ওর সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু না কিছু এনে স্নিগ্ধাকে বলত," শুভেচ্ছা, শুভকামনা আর ভালোবাসায় ভরা থাক তোমার জীবন।"..ছোট্ট সেন্টের শিশি কখনও বা একটা ভয়েলের শাড়ি অথবা রাতে শোয়ার পোশাক ভালোবাসায় মুড়িয়ে শুভময় তুলে দিত স্নিগ্ধার হাতে আর তার সাথে একগুচ্ছ গোলাপ। হয়ত স্বামীর এইটুকু ছোট ছোট ভালোবাসার ছোঁয়াই জয় করার সাহস দেয় অনেক প্রতিকূলতাকে।
সেদিনের নতুন বৌ স্নিগ্ধা আজ নিজেও সন্তানের মা, তবুও ভালো ওর সন্তানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়। আর হবেই না বা কেন ও তো ছেলে তাই ঘটা করেই জন্মদিন হয় ওর। মাঝে মাঝে মনে হয় স্নিগ্ধার ওরও ছেলে,শাশুড়িরও দুই ছেলে আবার ওর বরের থেকে দশ বছরের ছোট ভাই মানে ওর দেওরেরও ছেলে তাই শাশুড়ির নিয়ম আর কাউকেই ভাঙতে হয়নি। যদিও শুভময়ের খুব শখ ছিলো আরেকটা কেউ আসুক তবুও কম আয়ের জন্য আর ভাইয়ের পড়াশোনার কিছু খরচও চালানোর জন্য আর ভাবা হয়নি।
বরের সাথে নিভৃত আলাপে আর আদরের ফাঁকে স্নিগ্ধা বলতো,"এই ভালো একটাই ছেলে কোন ঝামেলা নেই। মেয়ে হলে বেচারা কষ্ট পেত।"..শুভময় ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলত," মেয়ে হলে আমি জন্মদিন করতামই মাকে ঠিক বুঝিয়ে নিতাম।"..চুপ করে যায় স্নিগ্ধা, হয়ত বুকের সিন্দুকে জমা কথাগুলো ছটফট করে না বলতে পেরে ওখানেই।
স্নিগ্ধার দেওর চাকরি সূত্রে বাইরে থাকে পরিবার নিয়ে। ওরা ওদের নৈহাটির পুরোনো বাড়িতেই থেকে গেছে,বছরে এক বার দেওর জা আসে। কখনও বা কোন দরকারে একা দেওরও চলে আসে। শাশুড়িমার সঙ্গে ওরা থাকলেও ছোটছেলে আর বৌমা ওনার কাছে সেরা। সবার কাছে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন ছোট ছেলের আর বৌমার। স্নিগ্ধার জা হাউসওয়াইফ হলেও উচ্চশিক্ষিতা আর আধুনিকা। যদিও স্নিগ্ধাও বি.এ পাশ,তবে বিয়ের পর সেসব আর কোন কাজে লাগেনি মানে ঐ এপাশ ওপাশ আর ধপাশ। এখন মনে হয় কবে যে কি পড়েছিলো হয়ত আলুপটলের ঝুড়ি গোছাতে গোছাতে ভুলেই গেছে সবই আর ঐগুলোও ছাইপাশ হয়ে গেছে।
ওদের বাড়িটার খুবই দুরবস্থা,পুরোনো আমলের বাড়ি তাই সারানোটা খুব দরকার। কিন্তু বাড়িতে থেকে বাড়ি সারানো মানে ধুলো, ময়লা নানা হ্যাঁপা তারমধ্যে ওর শাশুড়ির আ্যজমা তাই ওনাকে ঐ ধুলোর মধ্যে রেখে..কি করে কি করবে এই নিয়ে ওরা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে। শেষে শুভময়ই ভাইকে বলে মাসদুয়েকের জন্য মাকে ওদের কাছে নিয়ে রাখতে। দাদার এতটাই অবদান সংসারে যে ভাই না বলতে পারেনা যদিও বৌয়ের কাছে বলতে গিয়ে খুবই একচোট শুনলো। " আমি বরাবরই একা থেকেছি আমার মত। তুমি তো জানো সারাদিন আমি ছেলের পেছনে ছুটোছুটি করি এছাড়া উইকএন্ডে আমার পার্টি ক্লাব বন্ধু বান্ধব এসব না করলে একঘেঁয়ে বোরিং লাইফে বাঁচাই মুশকিল।
" মা চিরকালই তো নৈহাটিতেই থেকেছে,একটা অসুবিধায় পড়ে দাদা বলেছে একটু মানিয়ে নিলে কি হবে? বেশি তো নয় মাত্র দুটো মাস।"
মিতা প্রচন্ড অসন্তুষ্ট হয়ে বললো," দেখো দুমাসের নামে কতদিন রেখে দেয় এখানে। বেশিদিন হলে আমি কিন্তু.."
শাশুড়ির সাথে এতগুলো বছরের সহাবস্থান স্নিগ্ধার কাছে একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই ওর মনটা ফাঁকা হয়ে গেলো। তাছাড়া উনি সংসারের কাজে সাহাজ্যও করতেন, অবশ্য কথাও শোনাতেন। তবুও ওটাই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো,একলা বাড়িতে দুজনেই দিনের বেশ অনেকটা সময় দুজনের সঙ্গী হয়ে থাকতো। ছেলে আর বরেরও মন খারাপ।
ছোটছেলের হাত ধরে এই প্রথমবার ওদের সংসারে পা রাখলেন ঊষা,এর আগে কতবার বলেছে ছেলে কিন্তু আসা হয়নি। কি সুন্দর সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট একদম টিভিতে যেমনটা দেখেন ঠিক তেমনি। সোফায় বসেই ব্যাগটা খুলে বসেছিলেন দাদুভাইয়ের জন্য আনা আমসত্ত্ব,নাড়ু আর মালপোয়া বার করতে।
" মা এগুলো সোফায় রাখবেননা,ইশ্ সব নোংরা হয়ে গেলো,একটু আগেই ঘর মুছে গেলো।"
রান্নাঘরে নিয়ে যত্ন করে ওগুলো খুলে নাতির হাতে দিলেন। তবুও নাতির মুখের হাসিটা উপভোগ করতে পারলেননা। বৌমার গম্ভীর আওয়াজ শুনলেন," এখন পড়াশোনা করো,পরে খাবে।"
ছোটছেলের কাছে এসে বড় বাধো বাধো লাগে ঊষার। একছাদের তলায় পাশাপাশি না থাকলে বোধহয় মানুষকে সবসময় চেনা যায়না।তাই হয়ত তিনিও আলো ভেবে এতদিন আলেয়ার পেছনেই ছুটেছেন। সবসময় অন্যের ভুল ধরতে পটু ঊষার এখানে এসে সবসময়ই মনে হয় এই বোধহয় কিছু ভুল করে ফেললেন। তবুও শুনতে হয়," ইশ্ গামছাটা এখানে রেখেছেন? তোয়ালে আনেননি? উফ্ আমার আর ভালো লাগেনা। সবসময় এত বলা যায়!"
মাঝে কেটে গেছে একমাস,প্রায়দিনই হিসেব করেন ঊষা কবে ফিরে যাবেন নিজের বাড়ি। বড়বৌমার সাথেও ঠোকাঠুকি হত মাঝে মাঝে। তবে কখনও ভয় লাগতোনা,বরং উনিই শুনিয়ে দিতেন দুটো কথা।
শুভময় বলে," আমাদেরও বড় ফাঁকা লাগছে মা তোমায় ছাড়া,তবে যা অবস্থা তুমি থাকতে পারতেনা। আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধুলোতে। তোমার বৌমা তো সারাদিন বাড়ি থাকে,ওর খুব নাজেহাল অবস্থা।"
এর মাঝেই একদিন ছোট নাতির কাছে শুনলেন বাড়িতে পার্টি আছে।" কিসের পার্টি গো দাদুভাই? তোমার জন্মদিন?"..নাতিকে হাসতে দেখে ঊষাও হাসেন,সত্যি তিনি বুড়ো হচ্ছেন। আরে ওর জন্ম তো ডিসেম্বরে এখন কি? মায়ের ডাকে চলে যেতে যেতে বলে গেলো,"বিকেলেই দেখতে পাবে।"..ঊষা মাংস খাননা,নিজের বাড়িতে থাকার সময় বড়বৌমা আলাদা বাসনে ওনার রান্নাটা করে সরিয়ে রেখে তারপর মাংসের কড়াইয়ে মাংস র়াঁধে। এখানে ওদের এইসব বালাই নেই সবই নাড়াচাড়া,একদিন বলতে গিয়ে কথা শুনেছেন। তাছাড়া ওনাকে ওরা রান্নাঘরেও ঢুকতে দেয়না। তাই এইসময়টা ঘরেই বসে থাকেন,চোখের বাইরে যা হচ্ছে হোক। রান্নাঘর থেকে মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। দুপুরে খাবার টেবিলে মিতাই বললো," আপনি রাতে কি খাবেন একটু বলে দেবেন রান্নার লোক বিকেলে এলে। আপনি তো আবার মাংস খাবেননা।"
কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন," আজ কেউ আসবে বাড়িতে? কোন অনুষ্ঠান আছে?"
আপনার ছেলে কিছু বলেনি আপনাকে? আমি তো বলেছিলাম বলতে। ইচ্ছে করলে আপনি বিকেলে একটু মঠ থেকে ঘুরে একেবারে সন্ধ্যের পর আসতে পারেন। আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে সন্ধ্যেয়, আজ আমার জন্মদিন।"
ঢোক গিললেন ঊষা,অনেক বছর আগে জেদের বশে স্নিগ্ধাকে যা বলেছিলেন আজ আর সে কথা মুখে বলতে সাহস পেলেননা। শুধু বললেন," নাহ্ আজ আর মঠে যেতে ইচ্ছে করছেনা হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। জন্মদিনের জন্য কিছু তো আনা হয়নি আমার,তুমি এই টাকাটা রাখো। ভালো থেকো,সুখে সংসার কোরো।"
শাশুড়িকে প্রণাম টনাম মানে অত ভক্তি মিতার নেই। মনে মনে বললো তা আর মঠে যাবে কেন এদিকে নজর রাখতে হবেনা?
সারাটা সন্ধে দরজা ভিজিয়ে ঘরেই কাটলো ঊষার। ছেলে অফিস থেকে আসার পর কেক কাটার সময় ছেলেই নিয়ে গেলো,সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। ওদের খাবার পানীয় সব কিছুর মাঝে নিজেকে বড় বেমানান লাগলো ঊষার। খুব ইচ্ছে করলো একটু নৈহাটিতে ফোন করতে,কিন্তু পারলেননা।কি করে বলবেন আজ ছোটবৌমার জন্মদিনের পার্টি চলছে এখানে।
নৈহাটির বাড়ির কাজ প্রায় শেষ,আর দিন দশেক বাদেই ঊষার যাবার কথা। ছোটছেলেই পৌঁছে দিয়ে আসবে। হঠাৎই দিন চারেকবাদে একটা দুঃসংবাদ আসে স্নিগ্ধার নাকি স্ট্রোক হয়েছে। আপাতত আই সি ইউতে আছে, বড় অসহায় লাগে শুভময়ের গলা। বড় নাতিটাও খুব অস্থির হয়ে আছে। ঊষাও এদিকে বড় অস্থির হয়ে উঠেছেন। " আমাকে নিয়ে চল বাবা নৈহাটিতে,কে জানে ওখানে কি হচ্ছে? আমার কিছু ভালো লাগছেনা।"
..." মা এত অস্থির হয়োনা,দাদা আমাকে বারবার বলেছে কয়েকটা দিন বাদে তোমায় নিয়ে যেতে। এখন ওদের বাড়ির অবস্থা ভালোনা।"
ঊষা বুঝতে পারেন উনার জন্য বাড়িতে ভীষণ অশান্তি। ওনার যাওয়া হচ্ছেনা শুনে ছোটবৌমাও ভালো করে কথা বলেনা। ছেলেকেও কথা শুনতে হচ্ছে। কদিন ভালো করে খেতে পারেননি ঊষা, ঠাকুরের কাছে শুধু বলেছেন আমার ছেলের সংসারটা ভেঙোনা ঠাকুর। মনে প্রাণে মানত করেছেন বড়বৌমার জন্য। অথচ একটা সময় ওর নিন্দা করে আত্মীয়স্বজনের কাছে কত সুখ পেতেন। সবসময় বলতেন," না আছে রূপ আর না আছে গুণ কি দেখে যে ছেলেটা ভুলেছিলো কে জানে?" ছোটছেলে গিয়ে বৌদিকে দেখে এলেও ঊষার যাওয়া হয়নি। স্নিগ্ধা এখন কিছুটা ভালো আছে বাড়িও এসেছে প্রায় দশদিন নার্সিংহোমে থাকার পর,তবে ডাক্তার অনেক কিছু বারণ করেছেন।
মাঝে কেটে গেছে তিনটে মাস ঊষা ফিরছেন অনেক মাস বাদে নিজের বাড়িতে। হয়ত তেমন সাজানো গোছানো নয়,পুরোনো বাড়ি। তবুও বড় আপনার জায়গা এখানে বড়ই শান্তি আর স্বস্তি।বিয়ের পর থেকে এখানেই তো কেটে গেছে এতগুলো বছর।
শুভময় আর নাতি এসে জড়িয়ে ধরে ওনাকে। হয়ত ছোটছেলের মুখেও স্বস্তির হাসি। সবাইকে দেখতে পেলেও ঊষার চোখদুটো আজ স্নিগ্ধাকেই খুঁজছে। তাড়াতাড়ি করে ঘরে আসেন,স্নিগ্ধার শরীরটা বড় ভেঙে গেছে, বাড়ি ঘর গোছাতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমেই বোধহয় এমনটা হয়েছে। উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা,ওর হাতটা এখনও ঠিক চলছেনা। " থাক বৌমা,আয়ুষ্মতী হও সুস্থ হয়ে ওঠো তাড়াতাড়ি। কি যে চিন্তায় ছিলাম আর বোলোনা। যাক্ ঠাকুর রক্ষা করেছেন।"
আজ ঊষার চোখটা সত্যিই ছলছল করছে কথাগুলো বলতে পেরে। স্নিগ্ধারও ভালো লাগছে আসলে শাশুড়িমায়ের সাথে থাকাটা কখন যে অভ্যেস হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। ওর মা চলে যাওয়ার পর হয়ত বা অবলম্বনও।
অনেকদিন বাদে আবার নিজের ঘর,রান্নাঘর,অভ্যেসের বিছানায় এসে মনটা বড়ই শান্ত ঊষার। খুব ভালো করেই বাড়িঘর সারিয়েছে ওরা। বেশ নতুন নতুন লাগছে সব। নিঃসঙ্কোচে রান্নাঘরে ঢুকলেন অনেকদিন বাদে পছন্দমত কিছু রান্না করলেন। যদিও বড় ছেলে এসে একবার বকুনি দিয়ে গেলো," রান্নার মেয়েটাকে দেখিয়ে দাও ও করবে,তোমার কি দরকার?"
মাঝে কেটে গেছে একটা মাস,স্নিগ্ধা এখন একটু ভালো। " মাকে দেখেছো তুমি,ঘরে বাগানে কোথাও দেখছিনা তো?"..শুভময় তখনও বিছানায় গড়াচ্ছে ছুটির দিনের আলস্যে। " তুমি এত সকালে উঠেছো কেন? হয়ত ফুল তুলতে গিয়ে কারো সাথে কথা বলছে বাইরে। অত ছটফট কোরনা বিশ্রাম নাও।"
বিছানায় শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগেনা স্নিগ্ধার,বাথরুম থেকে একেবারে স্নান করে বেরোয়,অনেকদিনের অভ্যেস এটা। ঘরে ঢোকেন ঊষা। "মা আপনি?"
ওকে হাত দেখিয়ে ঘরে ঢুকে যান। ততক্ষণে স্নিগ্ধার শাড়ি পরা হয়ে গেছে,অনেকদিন বাদে নাইটির বদলে শাড়ি পরলো। শুভময়েরও কেন যেন খুব ভালো লাগলো অনেকদিন বাদে পরিচিত সাজে স্নিগ্ধাকে দেখে।
" বৌমা এদিকে এসো তো দেখি।"
স্নিগ্ধার মাথায় ঠাকুরের ফুলটা ঠেকিয়ে,কপালে ছোঁয়ান ঊষা। "মানত করেছিলাম,তুমি সুস্থ হয়ে গেলে পুজো দেবো। তাই ঠাকুরবাড়িতে গিয়েছিলাম ভোর ভোর। টেবিলে আয় সবাই এবার।"
সুন্দর করে টেবিলে সাজানো গরম কচুরী তরকারি আর জিলিপি সাথে পায়েস। খুশি হয়ে ওঠে শুভময়," কখন করলে এসব?"
"পায়েসটাই শুধু করেছিরে,ওগুলো গরম ভাজছিলো,ভোলাকে দিয়ে আনালাম।"
স্নিগ্ধার প্লেটে ছোট্ট বাটিতে অল্প পায়েস আর একটা মিষ্টি সাথে দুটো কচুরী। পায়েসের বাটিটা তুলতেই একটা ছোট চিরকুট চোখে পড়লো।
" বৌমা,
কত যুগ বাদে চিঠি লিখছি তাও আবার তোমাকে। আসলে ভালো কথা বলার অভ্যেস নেই তো তাই মুখে বলতে পারলামনা খুব লজ্জা লাগলো। সবসময়ই তো খারাপ কথা বলে এসেছি। শুভ জন্মদিনে আমার শুভর ঘর আলো করে থেকো। এই পায়েসটুকু তোমার জন্য কম চিনি দিয়ে ভোরবেলাতেই বানিয়েছি।
ইতি..'মা'
চিঠিটা পড়ে চোখটা জলে ভেসে গেলো স্নিগ্ধার, আজকাল অসুস্থতার পর মনটা বড় অন্যরকম হয়ে গেছে। কিন্তু মা গেলো কোথায়? সকাল থেকেই তো ভাবছিলো প্রণাম করবে।
" মা আপনি পায়েস রান্না করেছেন আমার জন্য! কিন্তু এ বাড়ির বৌ মেয়েদের যে.."
বাকিটা আর বলতে পারেনা স্নিগ্ধা, হয়ত এর উত্তর ঊষার কাছেও নেই তাই ওকে কাছে টেনে নিয়ে হাতের মুঠোয় দেন চোখে ছোট্ট চুনী বসানো ওনার জোড়া মাছ দুল আর লকেট। স্নিগ্ধার খুব পছন্দ ছিলো ডিজাইনটা। ভালোবেসে বানানো ছোট্ট একবাটি পরমান্ন হয়ত খুশির পরমায়ু আরও দ্বিগুণ করে দিলো ওদের চারজনের ছোট্ট সংসারে।
©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী: কলমে রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।
সমাপ্ত:-
উপরের ছবি - লেখিকা রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
[ লেখিকার অনুমতি নিয়ে বন্ধু পত্রিকায় প্রকাশিত হল ]
ইতি কথা - কলমেঃ রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
Reviewed by Wisdom Apps
on
June 08, 2019
Rating:
No comments: