কিন্তু কয়েক বছর হল আমার এই নিঃসঙ্গ সময়টায় সঙ্গ দেবার একজন সঙ্গী পেয়েছি। বেশ কয়েক বছর আগে আমি বসে বসে ফেসবুকে চোখ বলাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল আমার ঘাড়-মাথার ওপর দিয়ে কে একজন আমার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চমকে ঘাড় তুলে দেখি গাছটা ডাল পাতা নিয়ে ঝুঁকে যেন আমার মোবাইলটা দেখছে। ভাবলাম মজা মন্দ নয়। এই গাছটার সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান কোরলে কেমন হয়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মনে মনে গাছটাকে বললাম, “কি হে, কি দেখছ?”
হাওয়ার ফিস্ফিস্ শব্দে উত্তর এলো, “তোমার ওই যন্ত্রটায় অনেক খবর থাকে, তাই দেখি”।
(২)
“ধ্যাৎ, তুমি তো একটা গাছ, তুমি খবর পড়বে কি কোরে? তুমি অক্ষর চেনো?”
“খবর পড়ি বলি নি তো, বলেছি খবর দেখি। তোমার ওই যন্ত্রটায় অনেক ছবি থাকে, সেগুলো দেখি আর খানিক বাদে তোমার বন্ধুরা এলে তোমরা যে বক্বক্ করো, সেগুলোকে জুড়ে নিয়ে আমি খবর পেয়ে যাই”।
“বাবা, তুমি তো বেশ বুদ্ধিমান গাছ হে?”
“কেন, গাছের বুঝি বুদ্ধি থাকতে নেই”।
একটু বিরক্ত হয়ে বলি, “দেখো, গাছের প্রাণ আছে, এটুকু মানতে পারি, কিন্তু, গাছের বুদ্ধি? একটু আষাঢ়ে গল্প হয়ে যাচ্ছে না?”
“বাঃ, তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে একটা গাছের সঙ্গে গল্প কোরছ, এটা যদি তোমার বন্ধুরা শোনে, তাহলে তারাও কি এটাকে আষাঢ়ে গল্প বোলবে না?”
মনে মনে একটু থমকে গেলাম। সত্যিই তো। নির্মলদা, সমাদ্দার, এরা যদি জানতে পারে যে আমি একটা গাছের সঙ্গে কথা বলি, তাহলে ওরা আমায় ব্যান্ডেল অব্দি পৌঁছতে দেবে না, তার আগে মানকুন্ডুতে নামিয়ে পাগ্লা-গারদে ভর্তি কোরে দেবে। একটু আমতা আমতা কোরে বলি, “হ্যাঁ--- তা বটে”।
আমগাছ উৎসাহিত হয়ে বলে, “তা হলে?”
আমি বললাম, “তা হলে একজন বুদ্ধিমান মানুষ যদি একটা বুদ্ধিমান আমগাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরতে চায়, তবে কি আমগাছ রাজি হবে?”
আমগাছ তার সব ডালপাতা দুলিয়ে বাতাসে ফিস্ফিসিয়ে উঠল, “রাজি----রাজি”----
এইরকম কোরে বেশ কয়েক বছর হল আমাদের বন্ধুত্ব ক্রমে গাঢ় হয়েছে। আমি কোন সময় ছুটিতে যাবার আগে গাছকে জানিয়ে যাই, “কদিন থাকব না হে। ছুটিতে যাচ্ছি।
“কেন, কোথাও বেড়াতে যাবে?”
“আরে না, শালির ছেলের বিয়ে, একটু দেখাশোনা কোরতে হবে।“
“ও--- ফিরে এসে বিয়ে বাড়ির গল্প শোনাতে হবে কিন্তু”।
(৩)
আবার পরপর কয়েকদিন বৃষ্টি হলে শেডের তলা থেকেই ট্রেন ধরতে হয়, তখনও কিন্তু একবার ছাতা মাথায় দিয়ে আমগাছের সঙ্গে দেখা কোরে আসি।
“বড্ড বৃষ্টি হচ্ছে হে, এখন আর তোমার তলায় বোসতে পারছি না। একটু রোদ উঠুক, তখন আসব”।
আমগাছ বিষন্নভাবে মাথা নাড়ে। এ খেলার কথা শুধু আমি আর আমগাছ জানে। সবাইকে একথা বলা যায় না। গাছের সঙ্গে কথা বোলতে হলে খুব অনুভূতিপ্রবন মন হতে হয়, সবার তা হয় না। ফলে জানাজানি হলে ঠাট্টার শিকার হতে হবে।
কদিন আগে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ক্লান্ত শরীরে ব্যাগটা রেখে একটু জল খেয়ে গাছতলায় গুছিয়ে বসলাম। অন্য সময় আমি এসে বসলে গাছটাই আগে কথা বলে। আজকে অন্যরকম দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হে, আজ যে বড় চুপ্চাপ্?”
“মনটা ভাল নেই।“
“কেন, কি হল আবার তোমার?”
“ওই যে সেদিন তোমরা বলছিলে না, রেলের বড়কর্তারা বিভিন্ন ষ্টেশনে শেড তৈরি করার জন্যে বড় বড় গাছের মাথার দিকটা কাটিয়ে দিচ্ছেন আর গুঁড়ি গুলোতে সুন্দর সুন্দর পশু, পাখি, মানুষের ছবি খোদাই করাচ্ছেন। তাই ভাবছিলাম আমারই বা আর কদিন, আমারও মাথাটা কেটে দিয়ে গুঁড়িতে হয়ত মুর্তি খোদাই করা হবে”।
আমি চমকে উঠলাম। তাইতো, এ কথাটা তো আমার মাথায় আসে নি। একটু সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললাম, “আরে না না, সব গাছই কি আর কাটা হবে? তুমি তো ষ্টেশনের এক প্রান্তে রয়েছ, তোমাকে ওরা কাটবে না”।
“কিন্তু সেদিন যে তোমরাই বলছিলে এইদিকটায় একটা শেড থাকলে ভাল হয়, বর্ষার সময় খুব অসুবিধে হয় তোমাদের”!
আমার মুখে আর কথা জোগাল না। গাছটা খানিক বাদে হাওয়ায় ফিস্ফিস্ কোরে বলল, “সেদিন তুমি বন্ধুদের সঙ্গে ফেস্বুকে একটা ছবি দেখছিলে। সেই সিরিয়া না কোথায় যেন যুদ্ধের সময় বিষ-বাষ্পের বলি হয়েছে কটা বাচ্ছা
(৪)
ছেলে। ওদের ছোখগুলো আধখোলা, মুখগুলো সামান্য হাঁ হয়ে আছে। হয়ত শেষ সময়ে একবার প্রাণপণ নিশ্বাস নেবার চেষ্টা কোরেছে, বাঁচবার চেষ্টা কোরেছে। আমার মাথাটা যখন রেল বাবুরা কাটিয়ে দেবে, তখন আমার গুঁড়িতে ওই বাচ্ছাগুলোর মুখ খোদাই কোরে দিলে বেশ হয়। মরা গাছের গায়ে মরা ছেলেদের মুখ। বেশ সুন্দর হবে না? বেশ ভাল হবে না দেখতে? কি গো, তোমার ভাল লাগবে না? কথা বলছ না কেন? কথা বল। কি গো”-----
লেখক ঃ
প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী।
কাজিডাঙ্গা, পোঃ – দেবানন্দপুর, জিলা – হুগলি,
পিন্ - ৭১২১২৩ ,ই-মেল – pradeepchkrbrty@yahoo.co.in
আমি আর আমগাছ - প্রদীপ নারায়ণ চক্রবর্ত্তী।
Reviewed by Wisdom Apps
on
May 15, 2019
Rating:
No comments: