স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (১৭৫৫ - ১৮৪৩)
মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে গেল তার। ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারলেন, পেটে খিদে চোঁ-চোঁ করছে। অথচ খাবার মতো কিছুই নেই রান্নাঘরে। কি আর করা যায়। ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলেন তিনি। আবার ছেঁড়া কম্বল ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন।
জানালায় কাচের সারশী নেই। হু-হু করে ছুটে আসছে শীতার্ত বাতাস। দূর থেকে রাতজাগা পাখির ডাক শোনা গেল। বেচারি ছটফট করতে পারেন। খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে ওঠেন।
আপনারা হয়ত ভাবছেন , আমি বোধহয় একটা সামাজিক গল্প লিখছি। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যে মানুষটির কথা এতক্ষণ বলা হয়, প্রায় রাতে তিনি ঘুমোতে পারতেন না খিদের জ্বালায়। তিনি হলেন হোমিওপ্যাথি শাস্ত্রের জনক স্যামুয়েল ক্রিস্টিয়ান ফ্রেডরিক হ্যানিম্যান। পথেঘাটে তার নামে নামাঙ্কিত অনেক দোকান তোমাদের চোখে পড়বে। সেখানে কাছের শিশিতে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ থরে-বিথরে সাজানো আছে। হ্যানিম্যান মানেই বিশুদ্ধ ওষুধের শেষকথা - এমনটিই মনে করেন ডাক্তারবাবুরা।
ভাবতে অবাক লাগে, যার নামে কোটি কোটি টাকার ওষুধ আজও বিক্রি হয়, জীবনটা তার কেটে গিয়েছিল নিদারুন দারিদ্রতার সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রাম করে।
১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ই এপ্রিল এক হতদরিদ্র পরিবারে হ্যানিম্যানের জন্ম হয়। জন্মেছিলেন তিনি জার্মানির অন্তর্গত সাক্সলি প্রদেশে।
বাবার নাম ক্রিশ্চিয়ান গটফ্রেড হ্যানিম্যান। তিনি ছিলেন এক গরিব শিল্পী। যখন যা ইচ্ছা হত তাই আঁকতেন। বেশিরভাগ দিন অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতেন তিনি। অনেকেই বলত, 'গটফ্রেড, এঁকে কি হবে? তার থেকে বরং মুটে হয়ে যাও। রোজ দুশো টাকা আয় করতে পারবে। সংসারটা কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যাবে। কিন্তু এভাবে ছবি আঁকলে তো পেটের খিদে পেটেই থেকে যাবে।'
এই কথা শুনে হেসে উঠতেন গটফ্রেড হ্যানিম্যান। জীবনে কখনও কোনো কিছুর সাথে আপস করেননি তিনি। এই দারিদ্র্যতা- এ তো ঈশ্বরের দান- এমনটাই বিশ্বাস করতেন তিনি। তারপর আবার নতুন উৎসাহে আবার ছবি আঁকা শুরু করতেন।
হ্যানিম্যানের ছোটবেলা কেটে গিয়েছে এই দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে। তিনি ছিলেন মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। সুখ বা স্বচ্ছলতা কাকে বলে তা তিনি জানতেন না।
একটি রুটি সম্বল করে খিদের জ্বালা মেটাতে হত। অর্ধেকটা খেতেন জলে ডুবিয়ে, বাকিটা নুন দিয়ে। রুটির সাথে তরকারি হলে বাড়িতে একটি উৎসবের পরিবেশ তৈরি হত।
অর্থের অভাবে ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। পড়তেন স্থানীয় করপোরেশন বিদ্যালয়ে - নিখরচায়। একটিমাত্র পোশাক ছিল তার। ময়লা হলেও সাবান কিনতে পারতেন না। আলু দিয়েই পোশাক পরিষ্কার করতেন।
কঠোর দারিদ্র্যতা তার প্রতিভাকে ঢেকে রাখতে পারেনি। কিভাবে তিনি জীবনে সফল হয়েছিয়েন তা জানলে আমরা অবাক হয়ে যাই ! আমরা নিজেদের ধিক্কার দেই আর ভাবি, হ্যানিম্যানের মতো মানুষ যদি জীবন যুদ্ধে জিততে পারেন, আমরা কেন পারব না? কোনোরকমে লিপিজিগ বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেন হ্যানিম্যান। মনের ভেতর ইচ্ছে ছিল চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করবেন। তখনকার দিনে এই বিষয়ে পড়তে গেলে অনেক টাকার দরকার। তত্ত্বগত শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষা - তা নাহলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের জ্ঞান সম্পূর্ন হয়না। বেচারি হ্যানিম্যান, কে তার দিকে বাড়িয়ে দেবে সহযোগিতার হাত?
বাবার পাঠানো সামান্য অর্থ সম্বল করে তিনি ভিয়েনাতে পড়তে গিয়েছিলেন। তখন ভিয়েনার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কেন্দ্র বলা হচ্ছে ভিয়েনা শহরকে। সেই অপ্রতুল অর্থের ভরসায় শেষ অব্দি আর জীবনযুদ্ধে লড়তে পারেননি হ্যানিম্যান। মাঝপথেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল তাকে। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছিল তাকে।
ঘুরতে ঘুরতেই তার সাথে দেখা হয়ে যায় ট্রানসিলভেনিয়ার গভর্নরের। ভদ্রলোক হ্যানিম্যানকে দেখেই বুঝেছিলেন, এই কিশোরটি আসলে ছাই চাপা আগুন। তিনি হ্যানিম্যানকে তার পরিবারের গৃহচিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করলেন।
এবার বোধহয় ভাগ্যের চাকা উল্টোদিকে ঘুরছে। ট্রানসিলভেনিয়ার সেই গভর্নরের বাড়িতে ছিল একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। অনেক মূল্যবান বই ছিল সেই লাইব্রেরিতে।
গভর্নর নিজেও ছিলেন শিক্ষানুরাগী। অন্যান্য প্রশাসকেরা যেমনটি হয়ে থাকেন, বিলাসী জীবনযাত্রার প্রতি সীমাহীন আগ্রহ থাকে তাদের - এই গভর্নর কিন্তু তেমন ছিলেন না।
হ্যানিম্যানের আগ্রহ লক্ষ্য করে তিনি অনুমতি দিলেন, যতক্ষন ইচ্ছে হ্যানিম্যান ওই লাইব্রেরি কক্ষে থাকতে পারেন। শুধু তাই নয়, সুবিশাল এই গ্রন্থাগারটির রক্ষনাবেক্ষনের সমস্ত দায়িত্ব হ্যানিম্যানের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ছোটো থেকেই পড়াশোনাকে ভীষণ ভালোবাসতেন হ্যানিম্যান। মূল্যবান বই কেনার পয়সা ছিল না তার। লাইব্রেরিতে সদস্য হবেন, এটাই ছিল দুরাশা। এতদিনে তার স্বপ্ন সফল হল। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রগতিশীল লেখকদের লেখার সাথে পরিচিত হয়ে উঠলেন। এমনকি গভীর অধ্যবসায়সহকারে চারটি ভাষা শিখে ফেললেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রই ছিল তার আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন, এই বিদ্যা টিকে ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারলে আমরা আর্ত-নিপীড়িত মানুষের সেবা করতে পারি। কিছুদিন বাদে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন, নতুন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে, যা স্বল্প খরচে মনুষের রোগের উপশম করবে।
একদিন তিনি মনের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেন গভর্নর সাহেবের কাছে। হ্যানিম্যান ভেবেছিলেন, তার এই অদ্ভুদ ইচ্ছের কথা শুনে গভর্নর হয়তো রেগে যাবেন, হয়তো তাকে কাজ থেকে বরখাস্ত করবেন। কিন্তু শেষ অব্দি সেসব কিছুই হয়নি। বরং বিদ্যানুরাগী গভর্নর হ্যানিম্যানকে উৎসাহিত করলেন। যাতে তার প্রতিভা ঠিক মতো বিকশিত হতে পারে।
ধীরে ধীরে হ্যানিম্যানের সুখ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এভাবেই তার প্রতিভাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়।
সারাজীবন ধরে হ্যানিম্যান নানা গবেষণা করে গেছেন। তার সবথেকে বড়ো কৃতিত্ব ' হোমিওপ্যাথি' নামে একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির উদ্ভাবন করা। অনেকে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ঠিক মতো নিতে পারেন না। তাদের শরীরে নানা উপসর্গ দেখা যায়। এতদিন বাধ্য হয়ে তারা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হত। হ্যানিম্যানের আবিষ্কার তাদের নতুন পথের সন্ধান দিল।
হ্যানিম্যান তাদের বোঝালেন, দেহমনের অভ্যন্তরীন বৈকল্যই হল ব্যাধি। রোগের মূল ধরে চিকিৎসা করলে তবেই তার নিরাময় সম্ভব। হোমিওপ্যাথি সেই বিশৃঙ্খলাই সারিয়ে তোলে। তিনি বললেন, তোমরা আমার কাছে এসো। আমি তোমাদের রোগ সারিয়ে দেব। অথচ এর কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হবে না।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শেষ জীবনে হ্যানিম্যান নিজেও একজন সফল চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। জীবদ্দশাতেই তিনি দেখেছিলেন, হোমিওপ্যাথির অসাধারন জনপ্রিয়তা।
শেষ অব্দি ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা জুলাই অষ্টআশি বছর বয়সে হ্যানিম্যান হয়ে গেলেন দূর আকাশের তারা। আজও তার প্রবর্তিত চিকিৎসা পদ্ধতি আমাদের মধ্যে সমান উৎসাহের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে। দুঃস্থ আতুর ব্যক্তিদের মধ্যে এই পদ্ধতি যাতে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেজন্য সরকারি তরফে কিছু ইতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবেই হ্যানিম্যানের আবিষ্কারের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান জানানো হবে।
চরম দারিদ্রতা থেকে কীভাবে হোমিওপ্যাথির জনক হলেন হ্যানিম্যান - স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জীবনী
Reviewed by Wisdom Apps
on
February 16, 2019
Rating:
No comments: