উত্তরাখন্ডের কৌশানি , আলমোড়া থেকে ৫২ কিমি উত্তরে ৬২০০ ফুট উচ্চতায় পাইনে ছাওয়া অপরূপ কৌশানি। মহাত্মা গান্ধী এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন সুইজারল্যান্ডের চেয়েও সুন্দর এই কৌশানি। ধুলো-ধোঁয়ার শহুরে জীবন থেকে পালিয়ে নির্মল প্রকৃতির কোলে কয়েকের মুক্তির আস্বাদ পেতে আদর্শ স্থান এই কৌশানি। পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে হিমালয়ের রুপালি রেখা। আবহাওয়া ভাল থাকলে, মেঘমুক্ত দিনে দেখা যায় প্রায় ৩০০ কিমি ব্যপ্ত হিমালয়ের তুষারাবৃত পর্বতমালার অপরূপ শোভা। চৌখাম্বা-নীলকণ্ঠ-নন্দাঘুস্টি-নন্দাদেবী-ত্রীশুল-নন্দাকোট-পঞ্চচুল্লি প্রভৃতি শৃঙ্গের মাথায় সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয় বিচিত্র আভা। ভোরের সূর্যদয়ের চেয়ে কৌশানির সূর্যাস্তের সৌন্দর্য অতুলনীয়। দিনান্তের শেষে আলোর আভায় সৃষ্টি হয় আক মায়াময় জগৎ । সূর্যাস্তের মুহূর্তে শুরু হয় রঙের খেলা। একেক রঙের আবরণ রাঙিয়ে দিয়ে যায় সমস্ত পর্বতমালা---সোনালী থেকে কমলা, তার থেকে নীলাভ। সবশেষে যেন সোনা ঝরা রঙ। মনে হয় কে যেন শাঁকের প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজা করছে পরমা প্রকৃতির। তারপর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় সব কিছু। এখানে বেড়াবার সবচেয়ে ভাল সময় মার্চ থেকে মে, সেপ্টেম্বর নভেম্বর। শীতের সময় প্রবল ঠাণ্ডা।
কৌশানিতে প্রবেশ পথেই রয়েছে নটরাজের বিশাল মূর্তি, একটু এগিয়ে কালি মন্দির ও সোমেশ্বর মন্দির। অনাশক্তি আশ্রম বা গান্ধী আশ্রম টি মনোরম। এখান থেকে চারপাশের অপরুপ শোভা ফুতে উঠেছে। আশ্রমের ধ্যান গম্ভির পরিবেশ ও মনকে আবিষ্ট করে। ১৯২৯ সালে এখানে ১২ দিন ছিলেন গান্ধীজী। আশ্রম প্রাঙ্গনে বসেই রচনা করেন গীতার অনাসক্তি। প্রার্থনার সময় ভোর ৫টা ও সন্ধ্যা ৬টা। গান্ধীজীর শিস্য সরলা বেনের তৈরি কস্তুরবা গান্ধী আশ্রমটিও সুন্দর। ১৯৬৪ সালে তৈরি এই আশ্রমটি লক্ষ্মী আশ্রম নামেও পরিচিত। এখানকার মেয়েদের তৈরি হস্তশিল্পজাত দ্রব্যের প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখা যায়। খোলা থাকে সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত।
হিন্দি সাহিত্যিক মহান কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের জন্মভূমি কৌশানি। তার বহু রচনায় ফুটে উঠেছে সংগ্রহশালা। খোলা থাকে সকাল ১০.৩০ থেকে বিকাল ৪.৩০ পর্যন্ত, সোমবার বন্ধ। হাতে সময় থাকলে ঘুরে নেওয়া যায় কৌশানি চা বাগান। পিঙ্গালকোট এই বাগানটি প্রায় ২০৮ বর্গ কিমি ব্যাপ্ত। এই বাগানের চা রফতানি হয় আমেরিকা ইউরোপে। দাম কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ঘুরে দেখার সময় সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ট পর্যন্ত, দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।।
কৌশানি থেকে মাত্র ৫ কিমি হাটাপথে পিননাথ। গোপালকোট পাহাড়ের এই গ্রামে রয়েছে প্রাচীন ভৈরব মন্দির। মন্দির চিত্রে রয়েছে পঞ্চপাণ্ডবের কাহিনি। ১৯২০ সালে ভুমিকম্নপের ফলে মন্দিরে বেশ ক্ষতি হয়। বর্ষার পরে যাওয়া যায় এই পথে। অক্টোবর মাসের মেলায় বহু মানুষের সমাগম হয় এখানে।
কৌশানি থেকে গরুড় হয়ে বাগেশ্বরের পথে ১৯ কিমি দুরত্বে মন্দির নগরী বৈজনাথ। গরুড় উপতক্যায় ১১২৫ মিটার উচ্চতায় গোমতীর তীরে এই জনপদ একসময় কাত্তুরি রাজাদের রাজধানি ছিল, নাম ছিল কার্ত্তিকপুরা। নবম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ১৮টি মন্দিরে পুজিত হন বৈজনাথ। কথিত আছে কোন এক ব্রাহ্মণী এই মন্দির স্থাপনা করেন। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে রয়েছে বামনি মন্দির। দূরে দূরে চোখে পড়ে পাহাড়ের সারি। গোমতীর তীর ধরে গাছ গাছালীর মধ্যে দিয়ে পথ গিয়েছে মন্দিরের দিকে। একটি দুটি নয়, একগুচ্ছ মন্দির গড়ে উঠেছে গোমতীর তীরে। নির্জনতায় ঢাকা চারপাশের আপরুপ শোভা মনকে ভরিয়ে তোলে। এখানকার মুল আকর্ষণ পার্বতী মন্দির। জনশ্রুতি এখানেই বিবাহ হয়েছিল শিব-পার্বতীর। মন্দিরের স্থাপত্য চোখে পড়ার মত। ভেতরে রয়েছে ৬ ফুট উঁচু দেবি পার্বতীর মূর্তি, এছাড়াও শিব, গনেশ, কার্ত্তিক, নারায়ানের আরও নানান দেব দেবীর মূর্তি। একাধিকবার বিধর্মীদের হাতে লুন্ঠিত হয়েছে মন্দির। চারপাশে সুন্দর প্রকৃতির মাঝে মাঝে নিরালা মন্দির। সিঁড়ি নেমে গিয়েছে গোমতীর তীরে। এখানে শীর্ণকায় গোমতী। এখান থেকে গোয়ালধামের পথে ৮ কিমি দূরে রয়েছে কোটকিমায়ের মন্দির। বৈজনাথ থেকে বাগেশ্বরের দুরত্ব ২১ কিমি।
কৌশানির ১২ কিমি দূরে আলমোড়ার পথে ছোট গ্রাম সোমেশ্বর। মুল পথ থেকে আধ কিমি গিয়ে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রাচীন শিবমন্দির। রাজা সোম চাঁদের তৈরি এই মন্দির স্থানীয় মানুষের কাছে খুবই পবিত্র। জীর্ণ হয়ে এলেও এর কারুকার্য ভাস্কর্য দর্শনীয়। শিবরাত্রির সময় দূর দুরান্ত থেকে মানুষেরা এখানে আসেন।
কিভাবে যাবেনঃ নিকটবর্তী বিমানবন্দর পন্থনগর(১৭৮ কিমি) ও রেলস্টেশন কাঠগোদাম(১৩২কিমি)। বাস ও শোয়ার গাড়ি আসছে আলমোড়া, নৈনিতাল(আলমোড়া হয়ে), বাগেশ্বর, সোমেশ্বর(১২ কিমি) অ গরুড়(১৬ কিমি) থেকে। উৎসাহী পর্যটকরা কৌশানি থেকে দিনে দিনে ঘুরে নিতে পারেন বৈজনাথ-বাগেশ্বর-গোয়ালধাম।
এই লেখাটি শেয়ার করে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কাছে পৌছে দিন ।
ঘুরে আসুন, সুইজারল্যান্ডের চেয়েও সুন্দর ভারতের এই পার্বত্য অঞ্চলে
Reviewed by Wisdom Apps
on
January 22, 2019
Rating:
No comments: