"রেইকি" হল একটি জাপানী কথা। 'রে' ও 'কি' এই দুটি শব্দ দিয়ে তৈরী। জাপানী ভাষায় 'রে' শব্দের মানে হল সার্বভৌমিকতা, যার গূঢ় অর্থ হল আধ্যাত্মিক বুদ্ধিমত্তা এবং 'কি' শব্দের অর্থ হল জীবন শক্তি বা জৈব শক্তি। এক কথায় সর্বব্যাপী জীবন শক্তি। আরও সহজ করে বললে বলতে হয় জাপানি আধ্যাত্মিক স্পর্শ চিকিৎসা বিধি।
জাপানের এক প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি হল রেইকি। যদিও এর সঙ্গে অর্থাৎ এই পদ্ধতির সঙ্গে কোনো দেশ-জাতি-ধর্মের বিশেষ সম্পর্ক নেই। আধ্যাত্মিক ভাবনা, শরীরের জ্ঞান, প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং বিশ্বাস হলো এই পদ্ধতির মূলকথা।
এটার আবিষ্কার করেন বহু বছর আগে জাপানের ডা. মিকাও ইউসুই নামে এক মহাত্মা। যদিও ডা. ইউসুই নিজেই বলেছেন তিনি এই পদ্ধতির প্রবর্তক নন, পুনঃ আবিষ্কারক। তাঁর কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রাচীন কালে জাপানে এই পদ্ধতি বা আধ্যাত্মিক স্পর্শ চিকিৎসার প্রচলন ছিল। কালের বিবর্তনে তা কিছু কালের জন্য হারিয়ে যায় এবং ডা. ইউসুই তাকে পুনরায় আবিষ্কার করে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। আর শুধু জাপানেই নয়, এখন সারা পৃথিবীতেও রেইকির প্রচলন হয়েছে। যেমন ভারতে প্রাণ, চিনে 'চী', মুসলিম দেশে 'বর্ক', রাশিয়ায় 'বায়োপ্লাজমা' ইত্যাদি।
নাম যাই হোক আদতে পদ্ধতি একই।
এই বৌদ্ধ-চিকিৎসা পদ্ধতি তিব্বতের বৌদ্ধধর্মের 'ঔষধি-বুদ্ধ' নামক উপচার মার্গের একটা সূত্রের উপর আধারিত। এটি পারিভাষিক রূপ বা শৈল্পিক রূপ হিসাবে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ডা. ইউসুই একটি প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থে এই সূত্রের উল্লেখ দেখে এর পুনরাবিস্কার করেন।
তবে একটা কথা অবশ্য এখানে বলা প্রয়োজন তা হলো, রেইকি চিকিৎসা পদ্ধতির স্বরূপ এবং এর মূল ভাবনা বা সিদ্ধান্ত বৌদ্ধ দর্শন বা তার আদর্শের সঙ্গে খুব একটা মেলে না। কারন বুদ্ধদেব স্বয়ং কোথাও ঈশ্বর বা শিব বা শক্তি ইত্যাদির ব্যাখ্যা করেন নি। ঈশ্বরের অস্তিত্বের যাবতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি ছিলেন চির নীরব। তার বক্তব্য ছিল একটা অসহায়-অবলা পাখির শরীরে তির বিদ্ধ হলে মানুষের প্রথম কর্তব্য হলো তৎক্ষণাৎ সেই তির তুলে তার প্রাণ রক্ষার জন্য চেষ্টা করা। এটা অনেক পরের ভাবনা যে ওই তীর কে নিক্ষেপ করেছে বা কত দূর থেকে তা নিক্ষেপ করেছে। এই ভাবনার মধ্যেই তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট।
ডা. ইউসুই এই পদ্ধতি আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে এমন একটা প্রবল ইচ্ছা শক্তির তরঙ্গকে খুঁজে বের করেছেন যা মানুষের হাত ও করতলের মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়। আর এই বিচ্ছুরণ যে কোনো রোগকেই দূর করতে সক্ষম। এমন কি তিনি একথাও বলেছেন যে এই তরঙ্গকে রোগী পর্যন্ত সেই রোগীকে স্পর্শ না করে, তার শরীর থেকে 1-4 ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যবধান রেখে বা দুরস্থ কোথাও স্থিত হয়ে পৌঁছে দেওয়াও সম্ভব।
ঠিক এই জায়গাতেই একটা আধ্যাত্মিক ভাবনার বা ঈশ্বরীয় ভাবনার জন্ম হয়েছে। আমাদের দেশেও সিদ্ধ মুনি-ঋষিরা এই পদ্ধতিতে মানুষের রোগ নিরাময় করেছেন, এমন কি দুরস্থ রোগীর পর্যন্ত চিকিৎসা করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে ম্যাজিকের মতো মনে হতে পারে। বস্তুতঃ এটা হলো আধ্যাত্মিক শক্তি।
এই তরঙ্গ রোগীর সূক্ষ্ম শরীরের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এর কোনো ক্ষতিকারক দিকও নেই। ডা. ইউসুই দাবি করেছেন, এটা একটা দিব্যশক্তি, যা ব্রহ্মান্ড থেকে নেমে এসে রেইকি চিকিৎসকের শরীরে প্রবেশ করে এবং বেরিয়ে আসে।
স্বভাবতই বৌদ্ধ ভাবনার সাথে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বুদ্ধ ঈশ্বরের অস্তিত্বকে কখনো স্বীকার করেন নি। তাছাড়া এই রেইকি চিকিৎসা পদ্ধতির পারিভাষিক বা শৈল্পিক স্বরূপে 'শিব' ও 'শক্তি'-র ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চিহ্ন ও চক্রাদির সঙ্গে শাক্ত দর্শনের ভৈরবী চক্র ও বৈদিক দর্শনের শ্রী চক্রের সঙ্গে বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। সুতরাং এটা বেশ আস্থার সঙ্গে দেখা যায় যে এই চিকিৎসা পদ্ধতি শক্তিতন্ত্র-বিজ্ঞানের সঙ্গত ও অত্যাশ্চর্য বিধি গুলোর মধ্যে একটা।
তাছাড়া আরো একটা কথা এখানে ভাবার আছে। শাক্ততন্ত্র-বিজ্ঞানের মোটামুটি সমস্ত পদ্ধতি বা বিধিই এই ধরনের অলৌকিক বা দিব্য রেঞ্জকে লাভ করার বিধি। রেইকির কুন্ডলি, চিহ্ন, শিব, শক্তি ইত্যাদির বিবরণ এবং এর সুক্ষ্মতিসূক্ষ্ম শরীরের চক্রের ব্যাখ্যা শক্তি তন্ত্রেরই ব্যাখ্যা। যে ব্যাখ্যার অংশত বিকৃতি এবং অসম্পূর্ন ভাবনা থেকেই রেইকির ভাবনার জন্ম বলে অনেকে মনে করেন আর তা বহুলাংশে স্বাভাবিকও। বৌদ্ধ সাধুদের কারো কারো মধ্যে গূঢ়-সাধনার প্রতি আকর্ষণ জন্মাবার ফলে তারা শাক্ত তন্ত্রের অনেক বিধির প্রতি প্রভাবিত হন এবং গ্রহণ করেন। যদিও তাদের নিজেদের মধ্যে এর প্রামানিকতা ও ঔচিত্য নিয়ে দ্বন্দ্ব ও মত বিরোধ ছিলই। এক পক্ষের বক্তব্য ছিল এটা বৌদ্ধ ধর্ম ও আদর্শের পরিপন্থী। আর এক পক্ষের বক্তব্য ছিল এই মত ও বিধি বৌদ্ধ ধর্মের পরিপন্থী হলেও তার ঔচিত্য বৌদ্ধধর্মের বিকাশেরই সহায়ক।
যতদূর জানা যায় ডা. ইউসুই এই বিদ্যা অর্জন করেছিলেন কোনো বৌদ্ধ সাধকের কাছ থেকে। কিন্তু যেহেতু সাধন মার্গের কোনো সাধকের সঙ্গে জাগতিক বা সাংসারিক বিষয়-আশয় এবং প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না, অন্য দিকে ডা. ইউসুই এই বিদ্যাকে কাজে লাগান জাগতিক প্রয়োজনে।
অর্থাৎ সাংসারিক রোগ-নিরাময়ের কাজে তাই তাঁকেই এই বিদ্যা বা জ্ঞানের পুরোধা বলে প্রচার করা হতে থাকে।
পরবর্তী সময়ে তৃতীয় প্রজন্মের জনৈক মহিলা শিষ্য (ডা. ইউসুইয়ের) ডা. ইউসুইয়ের পদ্ধতি ও ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য মৌলিক ভাবে প্রচার করেন। এই প্রচারের মধ্যেই যে কোনো কারণেই হোক, কিছু কিছু মিথ্যা ও অবাস্তব ব্যাপার ঢুকে পড়ে। এমন কি ডা. ইউসুই সম্পর্কেও। মনে করা হয় এক্ষেত্রে মহিলা তাঁর ব্যবসায়িক লাভ ও নিজের ব্যক্তিত্ব উজ্জ্বল করতেই এমনটা করে থাকবেন।
যাইহোক নানা মতভেদ ও বিতর্ক সত্ত্বেও রেইকি চিকিৎসা, এর ক্রিয়াশীলতা এবং প্রভাবের প্রত্যক্ষ রূপ বেশ অদ্ভুদ এবং আশ্চর্যজনক। একে স্পষ্ট অনুভব করা যায় আর এই শক্তিকে ডা. ইউসুইয়ের পদ্ধতিকে খুব সহজেই অধিতও করা যায়। তাই স্বভাবতই একে অবৈজ্ঞানিক বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
জীবের জন্মকাল থেকেই রোগের জন্ম। রোগকে দূর করার ক্ষমতাও তাই জীবের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই থাকে। জীব স্বয়ং যখন সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে চায় তখন বাইরের উপচার - তা কোনো সনাতন পদ্ধতিরই হোক বা তার বাইরের হোক, ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিই তাকে সুস্থ ও নিরোগ থাকতে সাহায্য করে। আর এটা তো আমরা সকলেই জানি যে রোগী বা জীব স্বয়ং যদি সুস্থ ও নিরোগ হয়ে ওঠার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা ব্যক্ত না করে তাহলে জগতের কোনো চিকিৎসকই তাকে সারিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন না। রোগ নিরাময়ে ইচ্ছাশক্তির একটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা তো আছেই।
এই ব্যাকুলতা ও প্রবল অবস্থার দ্বারা চালিত মানুষ স্বয়ং-উপচারের নানা পদ্ধতির প্রয়োগ করে এসেছে এবং বিকাশ সাধনে তৎপর হয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের জটিলতা যেমন যেমন বেড়েছে তেমন তেমন তার উপচারের জন্যও মানুষ অনুসন্ধিৎসু হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সর্বব্যাপী অব্যক্ত সত্তার অনুভব করে এসেছে। এবং সেই মতো তারা তাদের সুবিধা ও ভাবনা মতো ঐ সত্তার নামকরণ করেছে। এই অব্যক্ত সত্তাকে আরো বেশি অনুভব করার জন্য মানুষ সাধনা করেছে, পূজা করেছে, তপস্যা করেছে। ঈশ্বরের অর্চনা করেছে। তার সেই সত্ত্বাকে নিজের মতো আত্মস্থ করার চেষ্টা করেই নিজ-নিজ প্রাণ শক্তিকে বিকশিত করেছেন। পাশাপাশি সেই শক্তিকে নানা রোগের এবং নানা সমস্যার সমাধানের জন্য নিয়োজিত করেছেন। প্রাচীনকালের মুনি-ঋষিরাও এই প্রাণ-শক্তিকেই বস্তুতঃপক্ষে বিকশিত করেছেন। একই কাজ মহাত্মা বুদ্ধও করেছেন। এই জীব-শক্তিকেই তিনি বিকশিত করে জনকল্যাণের জন্য প্রয়োগ করেছেন রবিন একে বিকশিত করার জন্য পথের সন্ধান দিয়ে জন-মানসকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
আজও তিব্বতের বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠে বুদ্ধ কথিত বা প্রবর্তিত এমন কিছু পবিত্র, রহস্যময় এবং গুপ্ত বিধির প্রয়োগ করা হয়, যার ফলে নানা রোগ ও সমস্যার সঠিক নির্ধারণ সম্ভব হয়। বৌদ্ধ মঠের সন্ন্যাসীরা এবং লামরা সেই রহস্যময় গুপ্ত মন্ত্র ও শৈলীকে জিভ থেকে পায়ের তালুতে চালিত করে মানুষের চিকিৎসা করেন।
রেইকি এমনই সব বিধির অন্যতম একটি বিধি, যে বিধিতে বিভিন্ন রোগের উপচার এবং জীবনের জটিলতম সমস্যা সমূহের নিদান করা সম্ভব হয়।
রেইকি চিকিৎসা আসলে কি ও কোথা থেকে উৎপত্তি হল ?
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 04, 2018
Rating:
No comments: