দেবকুন্ড, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, কেওনঝাড়, সিমলিপাল ঘুরতে হলে এই ট্যুরটি বাল্বেশ্বর বা বালাসোর থেকে শুরু করুন। বালাসোর যাবার জন্য হাওড়া থেকে একাধিক ট্রেন রয়েছে। তবে ধৌলি এক্সপ্রেসে গেলে দিনে দিনে পৌঁছে যেতে পারবেন পাঞ্চলিঙ্গেশ্বর। কারন বালাসোর থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ এই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। নীলগিরি পাহাড়ের গভীর বন, গহীন অরন্য, ঘন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। ওড়িশা সরকারের পান্থশালা রয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান থেকে ২৪০ টি সিঁড়ি বেড়ে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর বা পাঁচটি শিবের মন্দিরে পৌছনো। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খুবই জাগ্রত শিব। স্বয়ং মহাভারতের একটি চরিত্র জরাসন্ধ পুজো করেছিলেন দেবতারা। একটি গাড়ী বা অটো ভাড়া করে দেখেনিতে পারেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, চসাখন্ড, রেমুনা।
পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে নীলগিরি উদলা হয়ে সিমলিপাল ফরেস্টের উদলা ডিভিশনে দেবকুন্ড। লুলুং থেকে দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। কুলডিয়া থেকে ৬৯, বালাসোর থেকে ৮৭ কিলোমিটার দূরে দেবকুন্ড নিয়মিত বাস যাচ্ছে, বালাসোর থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে উদলা। উদলা থেকে জিপে ২৮ কিলোমিটার দূরে দেবকুন্ড। পাহাড় আর জঙ্গল-শেষ ৫ কিলোমিটার গভীর জঙ্গল। চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা। ৫০ ফুট উঁচু থেকে জলধারা নেমে আসছে। নীচে কুন্ড অর্থাৎ মোট পাঁচটি ধারা রয়েছে। তাই এর নাম পঞ্চকুন্ড বা প্লেস অফ ফাইভ লেকস। দেবকুন্ড থেকে শতাধিক সিঁড়ি উঠে ঝর্না উৎসের দিকে গেছে। দেবী অম্বিকা তথা দুর্গামাতা মন্দিরটিও সেখানকার দ্রষ্টব্য স্থান। ১৯৪০ সালে ময়ুরভঞ্জের রাজাদের তৈরি মন্দিরে পুজো হয় আজও। চোখ মুগ্ধ করা প্রকৃতির মধ্যেই নানা রঙের চেনা-অচেনা পাখির ডাক নানান রঙের প্রজাপতির বর্ণালি, শোভা বাড়িয়ে তোলে এখানকার মাধুর্য্যকে। তবে যাতায়াতের সমস্যা আজও রয়েছে। তাই পর্যটনের মানচিত্রে এর নামডাক কম। সেখানে থাকতে গেলে একটু হতাশ হতে হবে, কারণ থাকার কোন বাব্যস্থা নেই। তবে সাধারন বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা র্য়েছে উদালায়।
কেওনঝাড়--- যাজপুর কেওনঝাড় রোড রেল স্টেশন থেকে বাস যায় ১১২ কিলোমিটার দূরে কেওনঝাড়ে। এ ছাড়াও বাস আসে ২২৫ কিলোমিটার দুরের ভুবনেশ্বর ছাড়াও রাজ্যের বিভিন্ন দিক থেকে। আবার কোলকাতার বাবুঘাট থেকে ওড়িশা সরকারের বাস যোশীপুর হয়ে কেওনঝর পৌছায়। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা শান্ত স্নিগ্ধ ছোট্ট পাহাড়ি শহর এই কেওনঝাড়। নানা ধরনের আদিবাসি দের বাস এখানে। যাদের মধ্যে রয়েছে সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা প্রভৃতি। বিভিন্ন চেনা অচেনা পাখির ডাক দিনের সব সময় শুনতে পাওয়া যায়। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পায়ে হেটে বা রিক্সায় জগন্নাথ মন্দির ঘুরে আসা যায়। মন্দির চত্তরে রয়েছে আরও নানান দেবদেবীর মন্দির। দুপুর ১২ টা থেকে বিকেল ৫.৩০ টা পর্যন্ত অবশ্য মন্দিরগুলির দরজা বন্ধ থাকে। আবার জিপ গাড়ি বা রিক্সা করে সেখানকার ছোট-বড় জলপ্রপাত ঘুরে নেওয়া যেতে পারে। ছোট জলপ্রপাত গুলি প্রায় ১০০ ফুট উঁচু আর বড় জলপ্রপাতগুলি প্রায় ২০০ ফুট উঁচু। শহরের পানীয় জল এই বড় জলপ্রপাত থেকে আসে। খুবই মনোরম এই জলপ্রপাতগুলি এখানকার পরিবেশ চরুইভাতির জন্য আদর্শ কেওনঝাড়ের ৩০ কিলোমিটার দূরে গো-নাসিক পাহাড়ের গুপ্তগঙ্গায় বৈতরণীর উৎস। এই উৎসস্থলটি দেখতে গরুর নাকের মতো। এখানে ব্রহ্মেশ্বর মহাদেবের মন্দির রয়েছে। পাহাড় থেকে একটি সুন্দর ঝরনাও নেমে আসছে। আবার দেখার মতো যায়গা টি হল গুপ্তগঙ্গা গো-নাসিকা গ্রামে ব্রহ্মেশ্বর মন্দিরের কাছে কুন্ড। ৪০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে যাজপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে সাগরে মিলেছে পুন্যতোয়া বৈতরণী। আবার অনেকে বলেন, বৈতরনী এসেছে মলয়গিরি পাহাড় থেকে। জিপ সরসরি নিয়ে যায় পাহাড়ে।কেওনঝাড়ের মাইল দশেক দূরে গন্ধমাদন পাহাড়। আবার যাজপুরের পথে ৩০ কিলোমিটার কাতারবেদা থেকে আরও ৭ কিলোমিটার ডান দিকে যেতে পড়ে সীতা বিঞ্জি পাহাড়ের গায়ে চতুর্থ শতকের ফ্রেস্কো, রুপ তাঁর আধখোলা ছাতার মতো। লোকে বলে রাবনের ছায়া এটি। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান ধরনের পাহাড়। কারোর নাম লব কারোর নাম কুশ। এ ছাড়া আছে বাল্মিকির আশ্রম, লব-কুশের জন্ম তথা সীতাদেবীর সূতিকাগৃহ ছাড়াও নানা কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
৪৫ কিলমিটার দূরে কেওনঝাড় থেকে বেড়িয়ে নেওয়া যায় তারিনী দেবির মন্দির। বৃক্ষতলে এখানে দেবীর পূজা করা হয়। এই দেবী খুবই জাগ্রত। বৈতরিনী নদীর এক পাড়ে কেওনঝাড় অপরপাড়ে ময়ুরভঞ্জ। পাহাড়ের গা দিয়ে আধ কিলোমিটার দূরে কুন্ডরুপী পাথরে ঘেরা দুরন্ত ঘূর্ণি অর্থাৎ ভিমকুন্ড। হালকা সবুজ জলের কুন্ডের গভীরতা ২৬০ ফুট। বৈতরনী এখানে অন্তঃসলিলা। তবে পাহাড়ের ফাটলে অদৃশ্য হয়ে ৩ কিলোমিটার দূরে আবার দৃশ্যমান হয়েছে। বৈতরনী। এখানে মাঝে মধ্যেই ভাল্লুক, হাতির দর্শন মেলা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে রাতে। এখানে কাছেই অনুচ্চ পাহাড়ে রয়েছে শিবের মন্দির। শাল-মহুয়া-পিয়াশাল-কেন্দু-অর্জুন গাছেদের ছাওয়ায় মাখামাখি অরন্য। এই অরন্যের পরিবেশে থাকার মতো ২ ঘরের সেচ বাংলো রয়েছে। সিমলিপাল----- এন এইচ ৬ ধরে ৬১ কিলোমিটার গেলে যশীপুর অর্থাৎ সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানের গেটওয়ে। উদ্যানের পশ্চিমে যোশীপুর আপ পুর্বে আর এক গেটওয়ে বারিপদা থেকে পিথাবাটা হয়ে পথ গেছে জাতীয় উদ্যানে। পূর্বঘাট পর্বত মালায় ময়ুরভঞ্জ জেলায় ৭৫৭ মিটার থেকে ১১৫৮ মিটার উচ্চতায় মহারাজাদের অতীতে মৃগয়া ভুমি ২৭৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ১৯৭৫ সালে গড়ে উঠেছে ভারতের বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান সিমলিপাল। কোর এলাকা ৮৪৫ বর্গ কিলোমিটার। গ্রানাইট পাথরের পাহাড়, গভীর বন, অপরুপ মোহময় পরিবেশ। ভারতের অন্যতম জাতীয় উদ্যান সিমলিপাল। জলপ্রপাত, ঝর্না, নদী নালা, আকর্ষন বাড়িয়েছে উদ্যানের। মহানদিও বয়ে চলেছে উপত্যকা চিরে। উত্তরে আর পশ্চিম ঘিরে এন এইচ ৬ ভারতে প্রথম গড়া ৯ সদস্যের টাইগার রিজার্ভের অন্যতম সদস্য সিমলিপাল। ১৯৭৩ তে কোর এলাকার ৩০০ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে টাইগার রিজার্ভে গড়েছে জাতীয় উদ্যান। ২০০৪ এর শুমারি মতে, ১০১০ টি বাঘ, ১১৯ টি চিতাবাঘের বাস সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে, তেমনই সিমলিপাল, কুলডিহা, হাড়গাড় ছাড়াও আরও ৫৩ টি জঙ্গলের অংশ জুড়ে ৭০৪৩ বর্গ কিলোমিটার ব্যাপ্ত হস্তী অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। ১৯৯৯-র শুমারি অনুযায়ী ৫৬৫ টি হাতির বাস সিমলিপালে। তবে বর্ষাকালে যাবার আগে জাতীয় উদ্যান সম্পর্কে জেনে যাবেন অবশ্যই।
দেবকুন্ড, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, কেওনঝাড়, সিমলিপাল ভ্রমণ গাইড
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 10, 2018
Rating:
No comments: