প্রাচীন মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর। সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আদিমল্ল রঘুনাম মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর বংশধর জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। পরবর্তীকালে মল্লরাজ বীরহাম্বির বৈষ্ণব পন্ডিত শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহন করে একজন পরম ভক্তে পরিনত হন। তিনিই মল্ল রাজবংশের কুলদেবতা ‘মদনমোহন’কে ভরে যায় আশপাশ। আজ বিষ্ণুপুরের অনন্য টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকাজ শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, সারা ভারতের গর্ব। নীচে দর্শনীয় মন্দিররাজির সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়া হল-
জোড় বাংলা মন্দিরঃ ১৬৫৫ খ্রীষ্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি এই জোড় বাংলা মন্দির। অনেকে এটিকে কৃষ্ণরায় মন্দিরও বলেন। দুটি বাংলা চালের উপর একটি শিখর এই মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর দেওয়ালের সর্বত্র আয়তকার পোড়ামাটির ব্লকে রামায়ন, মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা, শ্রীকৃষ্ণের নরলীলা, শিকার ও যুদ্ধ দৃশ্য উল্লেখযোগ্য। বাংলার টেরাকোটা মূর্তি শিল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন এখানে পরিলক্ষিত হয়।
কালাচাঁদ মন্দিরঃ মাকড়া পাথরে নির্মিত এই মন্দিরটি ১৬৫৬ খ্রীস্টাব্দে মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। একচূড়া বিশিষ্ট মন্দিরের সামনের দিকে পঙ্খের অলংকরনে কৃষ্ণলীলা ও পুরাণের দৃশ্যাবলী চিত্রিত রয়েছে।
রাসমঞ্চঃ ১৫৮৭ খ্রীস্টাব্দে মল্লরাজ বীরহাম্বিরের প্রতিষ্ঠিত অনুপম স্থাপত্যের এই রাসমঞ্চ। পিরামিডাকৃতি অভিনব গঠন শৈলীর এমন মঞ্চ ভারতবর্ষে বিশেষ চোখে পড়ে না। ইটের কার্ভিং এর কাজ বিস্ময়কর। এটি মন্দির নয়, তাই কোনো বিগ্রহ নেই। বার্ষিক রাসপর্বের সময়ে সমগ্র মল্লরাজ্যের যাবতীয় রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ এখানে একত্রিত করে মহাধুমধামে রাসোৎসব পালিত হতো।
রাধাগোবিন্দ মন্দিরঃ ১৭২৯ খ্রীস্টাব্দে মল্লরাজ গোপাল সিংহের পুত্র কৃষ্ণ সিংহ রাধাগোবিন্দ মন্দির তৈরী করেন।
রাধামাধব মন্দিরঃ মহারাজ গোপাল দিংহ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ ধর্মপরায়না চূড়ামনি দেবীকে মন্দিরটি রাধামাধবের শ্রীচরনে নিবেদিত।
শ্যামরায় মন্দিরঃ পশ্চিমবঙ্গের যাবতীয় টেরাকোটা মন্দিরের মধ্যে এই পাঁচচূড়া বিশিষ্ট শ্যামরায় মন্দির শিল্প নৈপুন্যে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। ১৬৪৩ খ্রীস্টাব্দে রঘুনাথ সিংহের তৈরী এই পঞ্চরত্ন মন্দিরটির সূক্ষ্ম কারুকাজ হতবাক করে দেয়।
রাধাশ্যাম মন্দিরঃ মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ ১৭৫৮ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা চালের ধাঁচে এক শিখর বিশিষ্ট ল্যাটেরাইট পাথরে এই একরত্ন মন্দিরটি রাধাশ্যামের চরনে অর্পন করেন। প্রবল আর্থিক অনটনের মধ্যেও পূর্বপুরুষদের মন্দির নির্মানের রীতি তিনি বজায় রেখেছিলেন। তারই ফলশ্রুতি রাধাশ্যাম মন্দির।
জগন্নাথ মন্দিরঃ রাজবাড়ি যাওয়ার পথে এই যুগল মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। কোনো মন্দিরের গায়ে প্রতিষ্ঠালিপি না থাকায় এদের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মানকাল স্পষ্ট নয়। গোল গম্বুজাকৃতি নির্মান কৌশল দেখে মন্দিরিদ্বয়ের নির্মানকাল অষ্টাদশ শতক বলে অনুমান করা হয়।
লালজী মন্দিরঃ পাথরের তৈরী এই মন্দিরের নির্মানকাল সঠিক ভাবে জানা যায় না। তবে এই একরত্ন মন্দিরটির নির্মান কৌশল নিতান্তই সাদামাটা।
গুমগড়ঃ এটি আসলে দরজা-জানালা বিহীন একটি চৌকো দালান বাড়ি। অনেক উঁচু এই গুমগড়ে যুদ্ধ অপরাধীদের এবং সাধারন অপরাধীদের মৃত্যুদন্ডের সাজা কার্যকর করা হতো। অনেকের মতে এটি ছিল রাজার শস্যভান্ডার।
গড় দরজাঃ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে মল্লরাজ বীরসিংহ মাকড়া পাথরের দুটি দরজা তৈরী করান। দুর্গ-সদৃশ্য দেখতে পরিখাবৃত পাথরের দরজাটিতে রাজার সৈনরা আত্মগোপঙ্করে শত্রুর ওপর নজর রাখতো। প্রয়োজনে গুলি চালনা করার জন্য চতুর্দিকে ছিদ্র ছিল। এছাড়া আরো একটি দরজা আছে খানিক তফাতে। তোরন সদৃশ স্থাপত্যটিতে ছোট গড় দরজা বলা হয়।
দলমাদল কামানঃ বিষ্ণুপুরের রাজাদের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে কামান ব্যবহারের প্রচলন ছিল। যদিও ইংরেজরা এখানকার বহু কামান অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছিল। তবে রয়েযাওয়া কামানগুলির মধ্যে দলমাদল বা দলমর্দন কামানই দ্রষ্টব্য।
মদনমোহন মন্দিরঃ বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ বংশের কয়েকশো বছরের উত্থানপতনের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে জাগ্রত দেবতা মদনমোহনের নাম। বিষ্ণুপুর মদনমোহনের লীলাক্ষেত্র। লোকমুখে বহুবিচিত্র কাহিনী প্রচলিতাছে প্রাণের ঠাকুরকে ঘিরে। তখন ১৭৪৩ সাল, মারাঠা সর্দার ভাস্কর পন্ডিত বিষ্ণুপুর আক্রমন করেন। তৎকালীন রাজা গোপালসিংহ্ মদনমোহন ঠাকুরের ওপর বিশ্বাস রেখে প্রতিরোদ্গের কোনো চেষ্টাই করলেন না। দুদিন বাদে ভীষন তোপধ্বনির গর্জনে বর্গীরা বিষনুপুর ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে ছিল। ভক্তদের বিশ্বাস মদনমোহন ঠাকুরই নিজে দলমাদল কামান দেগে বর্গীদের বিতাড়িত করেন। সমনের দিকটা খোপ খোপ নক্সা কাটা। এই মন্দিরের বিশেষত্বথামের অপরুপ কারুশিল্প। গোলাকার থামে খাঁজ কাটা ত্রিমাত্রিক গঠন শৈলী অনবদ্য। পশুপাখি থেকে শুরু করে মানব-মানবী সবই মন্দির গাত্রে জীবন্ত। মদনমোহন মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে গোস্বামী পাড়ায় শ্রীনিবাস আচার্যের সমাধিস্থল ও নিকটেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাধারমন মন্দির।
পাথরের রথঃ তেরশো শতাব্দীতে মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ মাকড়া পাথরের রথটি কৃষ্ণ ঠাকুরের জন্য তৈরী করান। চাকা বিহীন এই রথের কারুকাজ কালের বিনর্তনে অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
ছিন্নমস্তা মন্দিরঃ মেদিনীপুরের বিখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত কৃষ্ণচন্দ্র গুঁই ১৯৭৩ সালে বিষ্ণুপুরের মন্দির চত্বরের পশ্চিমে দলমাদল কামানের পাশে মা ছিন্নমস্তার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মার্বেল ও টাইলস দ্বারা নির্মিত আধুনিক মন্দিরে মহামায়া মা ছিন্নমস্তারূপে পুজিতা। রাজস্থানের মার্বেল পাথরে তোইরী রক্তবর্ণ দেবীমূর্তিটি অপূর্ব। বিষ্ণুপুর মেলার কথা বললে, ভ্রমন অসমাপ্ত। ইংরেজী বছরের শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ডসেম্বরের শেষে মন্দিররাজির প্রাঙ্গনে জলাশয়ের ধারে এই বিরাট মিলন মেলা বসে। আদিবাসী নাচ থেকে বালুচরী শাড়ি, সবই মেলে এই মেলায়। প্রতিদিনের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাড়তি আকর্ষন। মেলার সময় থাকার জায়গা পাওয়া কষ্টকর। তাই হোটেলের অগ্রিম বুকিং বাঞ্চনীয়।
নতুন মহলঃ উড়িষ্যার পাঠান সর্দার রহিম খাঁর বেগম ছিলেন লালবাঈ। মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ ধনরত্ন লুন্ঠনের আশায় উড়িষ্যা আক্রমন করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে লালবাঈয়ের রূপে-গুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিষ্ণুপুরে নিয়ে এলেন। রাজপুরীর বাইরে তাঁর থাকার জন্য আলাদা নতুন বাড়িটির নাম “নতুন মহল”। যদিও আজ ভগ্নপ্রায় রি বাড়িটি আগাছার অত্যাচারে জর্জরিত।
যাওয়াঃ- হাওড়া থেকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার, রূপসী-বাংলা এক্সপ্রেস, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস আর শালিমারথেকে আরন্যক এক্সপ্রেস সোজা বিষ্ণুপুর। ধর্মতলা থেকে সরকারি-বেসরকারি নানারকম বাস আছে। তবে সারা বিষ্ণুপুর জুড়ে অলি-গলি রাস্তা দিয়ে মন্দির দেখতে সারাদিনের চুক্তিতে রিক্সা ভাড়া করাই ভালো।
বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে - কি কি দেখার আছে ?
Reviewed by Wisdom Apps
on
September 01, 2018
Rating:
No comments: